গত কয়েক বছরে ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোতে সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে সরকার পালাবদলের ঘটনা ঘটেছে। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো নেপালের নাম। সেখানে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন আন্দোলন চলছিল।

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে সানাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করলে আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। একদিনের মধ্যেই সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও সহিংসতায় অন্তত ২০ জন নিহত হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগে বাধ্য হন।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জনেরও বেশি নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। প্রতিবাদকারীরা পার্লামেন্টে হামলা চালিয়ে কয়েকজন রাজনীতিবিদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নামানো হয় এবং দেশব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়।

কাঠমান্ডুর এই দৃশ্য ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা এবং গত বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিংস আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটানো তৃতীয় দেশ হলো নেপাল।

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হলেও নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ভালো। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক যোগসূত্র। নেপালের সঙ্গে ভারতের ১,৭৫০ কিলোমিটার খোলা সীমান্ত রয়েছে, যা উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত।

ভারতের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
সীমান্তের ওপারের ঘটনার ওপর ভারত গভীর নজর রাখছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে টুইট করেছেন, “নেপালের সহিংসতা হৃদয়বিদারক। এত তরুণ প্রাণহানিতে আমি মর্মাহত। নেপালের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি।” গত মঙ্গলবার তিনি মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকও করেছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যেভাবে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভারত অপ্রস্তুত ছিল, তেমনি নেপালের এই পরিস্থিতি তাদের বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে কে পি শর্মার দিল্লি সফরের ঠিক এক সপ্তাহ আগে পদত্যাগ এটিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।

কৌশলগত গুরুত্ব ও ভারতীয় প্রভাব
নেপালের অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড নেপালের সীমানার ওপারেই অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রবেশের পথ সরাসরি নেপালের ভেতর দিয়ে গেছে।

অস্থিরতার প্রভাব ভারতের অভ্যন্তরেও পড়ছে। দেশে প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি বসবাস বা কাজ করছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে গভীর পারিবারিক সম্পর্ক ও অবাধ যাতায়াত, ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই নেপালি নাগরিকরা ভারতে যেতে ও কাজ করতে পারেন। পাশাপাশি, নেপালের প্রায় ৩২ হাজার গুর্খা সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত।

সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক
নেপাল হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের হাজারো হিন্দু ভক্ত প্রতিবছর নেপালের বিভিন্ন মন্দিরে তীর্থযাত্রা করেন। ভারতের সঙ্গে নেপালের বার্ষিক বাণিজ্য ৮.৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে কাঠমান্ডু মূলত তেল ও খাদ্যপণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন সরকার বা নেতৃত্বে কে আসবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। ভারতকে এখন সাবধানে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের মতো আরেকটি অস্থির পরিস্থিতি তৈরি না হয়।

সীমান্ত ও ইতিহাস
ভারত ও নেপালের মধ্যে অতীতে সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের মানচিত্রে নেপাল দাবি করা এলাকা যুক্ত হওয়ায় বিরোধ তীব্র হয়। পরে নেপাল নিজস্ব মানচিত্র প্রকাশ করে। ভারত ও চীন সম্প্রতি বিতর্কিত সীমান্তের এক পয়েন্টে বাণিজ্য পুনরায় শুরু করেছে, যা নিয়েও নেপালের আপত্তি রয়েছে।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সংগীতা থাপলিয়াল বলেন, “নেপালে তরুণদের জন্য সুযোগ কম। ভারত যদি বেশি ফেলোশিপ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়, তাহলে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক কার্যত অচল হয়ে পড়ায় প্রতিবেশী অঞ্চলে একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিরতা সামলানো ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের বিশেষজ্ঞ মেহেতা বলেন, “ভারত বড় শক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু সেটি অর্জন করতে হলে আগে নিরাপদ ও স্থিতিশীল প্রতিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।”

 

news