২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে রাজধানী ঢাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচারে প্রাণঘাতী গুলি চালিয়েছে। সরকারি নথিতে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য—ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশে অন্তত ১২৪০ রাউন্ড প্রাণঘাতী গুলি ছোঁড়া হয়েছে। এই গুলিতে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে হাত-পা হারিয়েছেন, এবং কেউ কেউ এখনো হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আজকের প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব এই আন্দোলনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার, সরকারি নথির তথ্য, এবং এর ভয়াবহ মানবিক ক্ষতি সম্পর্কে।
দৈনিক মানবজমিনের খবরে বলা হয়, গত জুলাই-আগস্টে ঢাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালায়। সরকারি নথি অনুসারে, ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৯৫ জন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করেন। তাদের নির্দেশে পুলিশ, বিজিবি এবং আনসার সদস্যরা ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। বিশেষ করে রামপুরা, যাত্রাবাড়ী এবং মোহাম্মদপুরে ৭ জন ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ১২৪০ রাউন্ড ৭.৬২ ক্যালিবার চায়না রাইফেলের গুলি ছোঁড়া হয়। এই তথ্য উঠে এসেছে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় থেকে ট্রাইব্যুনালে পাঠানো একটি গোপন প্রতিবেদনে।
এই প্রাণঘাতী গুলির বেশিরভাগই ছিল ‘এইম অন ফায়ার’ পদ্ধতিতে, অর্থাৎ সরাসরি লক্ষ্য করে। ফলে ঢাকার অন্তত তিনটি স্থানে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানি এবং অঙ্গহানি ঘটেছে। রামপুরার বিটিভি ভবন ও আফতাবনগর এলাকায় সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে। ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। ১৮ জুলাই রামপুরায় ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একজন ডেপুটি কালেক্টর রেভিনিউর নির্দেশে আনসার ব্যাটালিয়নের একজন সহকারী পরিচালক ৫৪ রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। একই দিনে বিজিবি সদস্যরা শত শত রাউন্ড গুলি চালায়।
১৯ জুলাই রামপুরায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। সকাল ৮টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একজন সিনিয়র সহকারী কমিশনারের নির্দেশে ব্যাপক গুলিবর্ষণ হয়। একজন সুবেদার ২৬ রাউন্ড, একজন নায়েক ৮৩ রাউন্ড, একজন হাবিলদার ৭৭ রাউন্ড, এবং আরও অনেকে বিভিন্ন সংখ্যায় গুলি ছোঁড়েন। এই গুলিবর্ষণের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যা জনমনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। যাত্রাবাড়ী এবং মোহাম্মদপুরেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। ২০ জুলাই মোহাম্মদপুরে একজন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার নির্দেশে ৮০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়।
এই গুলিতে ব্যবহৃত ৭.৬২ ক্যালিবার চায়না রাইফেল একটি ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী অস্ত্র। পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. নাজমুল হুদা বলেছেন, এই অস্ত্র সচরাচর ব্যবহার হয় না, বিশেষ করে বেসামরিক মানুষের ওপর। এর গুলি ৩০০ মিটারের মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করলে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। এমনকি দূর থেকে গুলি লাগলেও শরীরের অঙ্গ ছিঁড়ে যায় বা ছিদ্র হয়ে যায়। এই অস্ত্রের বুলেট শরীরে বিদ্ধ হলে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই রাইফেল ৬ মিলিমিটার লোহার পাত, ১৫ মিলিমিটার ইটের দেয়াল, এমনকি ৩০ সেন্টিমিটার মাটির দেয়াল ভেদ করতে পারে।
এই প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকে হাত-পা হারিয়েছেন, কেউ কেউ উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন। হাসপাতালগুলো এখনো আহতদের ভিড়ে পূর্ণ। রামপুরার আফতাবনগর এবং বিটিভি ভবন এলাকায় ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের ঘটনা ছিল বিশেষভাবে মর্মান্তিক। এই সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশে বিজিবি ও আনসার সদস্যরা শত শত রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছেন, যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে।
এই ঘটনাগুলো জনমনে তীব্র ক্ষোভ এবং প্রশ্ন তুলেছে। কেন বেসামরিক মানুষের ওপর এত বড় মাত্রায় প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হলো? সরকারি নথিতে এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ায় এখন জনগণের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দাবি উঠছে। এই আন্দোলন এবং এর দমনপীড়ন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
জুলাই আন্দোলনে প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার এবং এর মানবিক ক্ষতি আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। সরকারি নথির এই তথ্য জনমনে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এমন দমনপীড়ন এড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।


