লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হলেও আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে পেঁয়াজের বাজার। মাঠ থেকে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন পেঁয়াজ, অথচ এখনও দেশে পুরোনো পেঁয়াজের মজুদ আছে এক লাখ টনেরও বেশি! এর পরও নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরবরাহ কমিয়ে সরকারকে আমদানির অনুমতি দিতে চাপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাদের আসল লক্ষ্য ভিন্ন।
বাস্তবতা হলো, ভোক্তার পকেট কেটে অতিরিক্ত মুনাফা করা। আর এই ফাঁদ অসাধুরা তৈরি করেছিল গত অক্টোবর থেকেই। সর্বশেষ দুই দিনে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে খুচরা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৬০ টাকায়। এতে বাজারে পণ্য কিনতে এসে চরম বিড়ম্বনায় পড়ছেন সাধারণ ক্রেতা। আর এই পুরো খেলায় প্রশাসন যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিবছর এই সময় মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত মৌসুমে কৃষকরা ন্যায্য দাম না পেয়ে প্রায় সব পেঁয়াজই বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে এখন তাদের কাছেও পেঁয়াজ নেই। সবটা দখলে নিয়েছে মজুতদাররা। এই সুযোগে তারা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজ বাজারে ছাড়ছে না, দাম বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে ভারত থেকে আমদানির জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে। তারা ভালো করেই জানে, নতুন ফসলের মৌসুমে সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেবে না। আর এই অজুহাতই কাজে লাগিয়ে তারা দাম হু-হু করে বাড়িয়ে চলেছে।
রাজধানীর বাজারের হালচাল
শুক্রবার রাজধানীর কাওরান বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজি ১৫০ টাকায়। নয়াবাজারে দাম ছিল ১৪০ টাকা। রামপুরা কাঁচাবাজারে সর্বোচ্চ ১৬০ টাকা এবং জিনজিরায় ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। অথচ মাত্র দুই দিন আগে পেঁয়াজের সর্বোচ্চ দাম ছিল কেজি ১১০ টাকা। আর গত অক্টোবরের শেষে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৭০ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৬০-৬৫ টাকা।
নয়াবাজারে কেনাকাটা করতে আসা মো. ইমদাদুল হক বলেন, "পেঁয়াজ নিয়ে একেবারে নৈরাজ্য চলছে। বাজারে পেঁয়াজ আছে, তবুও বিক্রেতারা এক মাস ধরে বেশি দামে বিক্রি করছে। আজ এসে দেখি এক লাফে ১৫০ টাকা! এটা দেখার কেউ নেই।"
একই দিন রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি আড়ত শ্যামবাজার ঘুরে আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচ কেজির একটি পাল্লা (প্রতিপাল্লা) পুরোনো পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। অর্থাৎ কেজি পড়ছে ১২০ টাকা। মাত্র চার দিন আগে এর দাম ছিল ৭০-৮০ টাকা। আর এক মাস আগেও শ্যামবাজারে এই পেঁয়াজ বিক্রি হতো ৬০-৬৫ টাকায়।
আড়তদার বনাম কর্তৃপক্ষ
শ্যামবাজারের আড়তদার হেদায়াত উল্লাহ বলেন, "দেশে পেঁয়াজের সংকট আছে। পুরোনো পেঁয়াজে গাছ (অঙ্কুর) হয়ে গেছে। নতুন পেঁয়াজ কৃষকরা ধরে রেখেছে। এ কারণেই সরবরাহ কম, দাম বেশি। সরকারকে এখন আমদানির অনুমতি দিতেই হবে। আমদানি করলে দাম কমে আসবে।"
কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মনিটরিং ও বাস্তবায়ন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. জামাল উদ্দীন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেন। তার মতে, "প্রকৃতপক্ষে বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। আমদানির অনুমতি দিতে সরকারকে বাধ্য করতেই সিন্ডিকেট চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। অথচ এখনও দেশে এক লাখ টনেরও বেশি পুরোনো পেঁয়াজ মজুত আছে।"
ভোক্তা সংগঠনের অভিযোগ
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, "পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে আড়তদার, কমিশন এজেন্ট ও দাদন ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। তারা পেঁয়াজ কিনে মজুত করছে, বাজারে ছাড়ছে না। দেশে ভালো উৎপাদন হলেও তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমদানির ফাঁদ পেতে আছে। মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি করা হলে কৃষকরা ঠকবেন। আর এখনই বাজারে নজরদারি না বাড়ালে ভোক্তাদের পকেট কাটা চলতেই থাকবে।"
বিটিটিসির প্রতিবেদন ও সুপারিশ
এদিকে, কারসাজির মাধ্যমেই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। তবে এরপরও তারা সীমিত পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানির সুপারিশ করেছে। খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় কমিশন এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সরকারের বিবেচনার জন্য বাণিজ্য ও কৃষি সচিবের কাছে পাঠিয়েছে।
কমিশন জানায়, কিছু মধ্যস্বত্বভোগী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থির করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে পেঁয়াজের দাম কেজি ৯০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ বাজারে তা ১১৫ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। উল্লেখ্য, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে এখন একই পেঁয়াজের দাম ৩০ টাকার মধ্যে।
