জেকে ১৯৭১: বাংলাদেশের জন্য এক ফরাসি তরুণের আত্মত্যাগের গল্প

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের সিনেমা ‘জেকে ১৯৭১’। এ সিনেমায় উঠে এসেছে এক বিদেশি মুক্তিযোদ্ধার সাহসী অভিযানের গল্প। যিনি নিজের কথা না ভেবে একটা অচেনা অজানা ভূখন্ডের মুক্তিকামী মানুষের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন। তার সেই দুঃসাহসিক কর্মকান্ডই দেখানো হয়েছে এ সিনেমায়।

১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ফ্রান্সের প্যারিসের অর্লি বিমান বন্দরের রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজ (পিআইএ) বোয়িং ৭২০ বিমান। বিমানটিতে ২৭ জন যাত্রী ও ৭ ক্রু রয়েছেন। যাত্রীদের অধিকাংশই পাকিস্তানী।  হঠাৎ বিমানবন্দরের রেডিও তারবার্তায় একটা বার্তা আসে। যা দেখে আতকে ওঠেন অপারেটরেরা। বার্তায় লেখা ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত মানুষ বিশেষ করে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের সাহায্যার্থে কিছু ঔষধ ওই বিমানটিতে তুলে পাঠাতে হবে। না হলে বিমানটি উড়িয়ে দেয়া হবে’। বার্তাটি যিনি পাঠিয়েছিলেন তার নাম জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে। তবে তিনি জ্যঁ ক্যুয়ে নামেই পরিচিত।

এমন বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছিনতাই করা বিমান সংলগ্ন টার্মিনাল এলাকা বন্ধ করে সাংবাদিক ও জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ। পরমুহুর্তে জ্যঁ ক্যুয়ে কৌশল বদলে আরেকটি বার্তা পাঠান ‘ফ্লাইট ৭১২ ছিনতাই করা হয়েছে এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর জন্য, বাংলাদেশের যোদ্ধাদের জন্য নয়’। কারণ তখন বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের অন্তর্গত কোন্দল হিসেবেই ধরা হত।

স্থানীয় সময় সকাল ১১.৫০ মিনিটে পিআইএ-র বোয়িংটির ককপিটে গিয়ে পাইলটের মাথায় ৯এমএম একটি পিস্তল ঠেকিয়ে তিনি দাবী তোলেন ঔষধ সামগ্রী পাঠাতে হবে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে। তার হাতে একটি বাক্স; সে বললো এটি বোমা। সাহায্য না পাঠালে বিমানটি উড়িয়ে দেয়া হবে। সে ঘটনা দেশটির টেলিভিশনেও ‘সরাসরি’ দেখানো হচ্ছিল। তখন পশ্চিম জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট সফরে এসেছিলেন ফ্রান্সে। এ সফরের উদ্দেশ্য নানা দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পেডুর সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করা। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় সব কর্মসূচী বাতিল করা হয়।এরপরেই আলোচনায় বসা হলো জ্যঁ ক্যুয়ে’র সঙ্গে।

তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ব্যক্তিগত কোনো লাভের ব্যাপার এখানে নেই। তিনি কেবল চান মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশে যেন ফ্রান্স সরকার ঔষুধ সরবরাহ করে সহায়তা করে। আর পিআইএর এই বিমানে করেই যেন সেই মালামাল বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়। তার দাবিও ফরাসী সরকার সহজে মেনে নেয়নি। সেনাবাহিনীর কমান্ডো বাহিনী অর্লি বিমানবন্দর ঘিরে ফেলে। তাকে বারবার আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। কিন্তু জ্যঁ ক্যুয়ে তার দাবিতে অনড়। এক পর্যায়ে বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটের দিকে ফরাসী সরকার তার দাবি মেনে নেয়। ফরাসী রেডক্রস ও অন্য একটি সাহায্য সংস্থার সহায়তায় দ্রুত ঔষধ সংগ্রহ করে অর্লি বিমান বন্দরে আনা হয় ১ টন ঔষধ। শেষাবধি পিআইএ-র ঐ বিমানেই তোলা হয় ১ টন ঔষধ এবং বাকী ঔষধ অনতিবিলম্বে প্রেরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়।

বিমানে ঔষধ বোঝাই করার মুহূর্তে মেকানিকের ছদ্মবেশে ২জন পুলিশ উঠে ককপিটে গিয়ে জ্যঁ ক্যুয়েকে আক্রমণ করে বসে এবং কিল-ঘুষিতে কাবু করে গ্রেপ্তার করে। পরে অঁদ্রে দ্য মল্টা নামের একটি সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে সেই ঔষধ বাংলাদেশে পৌঁছানো হয়েছিল। জ্যঁ ক্যুয়ের কাছে কোন বোমা ছিল না। যে বাক্সটি তাঁর হাতে ছিল তাতে কেবল কিছু বৈদ্যুতিক তার, বই, এক কপি বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রিক শেভার পাওয়া গিয়েছিল। তথাপি বিমান হাইজ্যাকের অপরাধে আদালতে তার বিচার হয়েছিল এবং তার ৫ বছর কারাদণ্ড হয়েছিল। তবে ১৯৭৩ সালে তাকে বিশেষ ক্ষমায় মুক্তি দেয়া হয়।

১৯৪৩ সালের ৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন জ্যঁ ক্যুয়ে। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই মানুষটি। কিন্তু যে দেশের জন্য তিনি এমন দুঃসাহসিক কাজ করলেন সেই দেশে আসা হয়নি তার কখনই। তিনি জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে গণমাধ্যমে নিরীহ বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যা, বাঙালিদের সংগ্রাম-প্রতিরোধ, শরণার্থীদের করুণ অবস্থা এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখে আমার মন জাগ্রত হয়। আমি পাকিস্তান সম্পর্কে তেমন কিছু জানতামও না। কিন্তু তাদের হিংস্রতা, নির্মমমতা আমাকে কষ্ট দিয়েছে।

এনবিএস/ওডে/সি

news