আসিফ আকবরের কণ্ঠে অসামান্য ঝঙ্কার আছে, গমগম করে ওঠে তাঁর কণ্ঠ : কবীর সুমন
সম্ভবত ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আসিফ আকবরের জন্য গান লেখেন। সুর করেন। আসিফ আকবরের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটি কীভাবে গড়ে উঠলো?
ভারতীয় সুরকার, সংগীতশিল্পী ও গীতিকবি কবীর সুমন: আসিফ আকবরের জন্য আমি প্রথমে ‘সিরিয়ার ছেলে’ নামে একটি গান তৈরি করি। সম্ভবত ২০২০ সালে। বাংলাদেশে আমার একজন অনুজপ্রতীম বন্ধু আছেন, মীর আরিফ বিল্লাহ। আরিফ আমাকে কাকু ডাকেন। আসিফ আকবরকে আমি চিনি কিনা জানতে চান। বলেন, ‘কাকু, আপনি কি বাংলাদেশের আসিফ আকবরের গান শুনেছেন?’ বললাম, ‘না’। আরিফ বললেন, ‘অনুগ্রহ করে ইউটিউবে তাঁর গান শুনুন। আসিফের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব আপনার সঙ্গে খুব মিলে যায়। খুব স্বাধীনচেতা। কারও পরোয়া করেন না। ভয় পান না। নির্ভিক। আসিফের গান শুনে যদি উনার জন্য কয়েকটা গান বানাতে পারেন’। মীর আরিফ বিল্লাহ বলার পর ইউটিউবে আসিফের গান শুনি। গান শুনে আমি ‘থ’! কী কণ্ঠ! উদ্দীপ্ত কণ্ঠে একেবারে হই হই করে গান গাইছেন আসিফ। আসিফের গলা আমার বেশ ভালো লাগে। আসিফের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিলো হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। আরিফ মিডিয়া হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর আসিফের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তারপর থেকে আসিফ আকবরকে গান লিখে ও সুর করে পাঠাতাম হোয়াটসঅ্যাপে। কী ধরনের যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করলে ভালো হয়, কখনো কখনো সে সম্পর্কেও কিছু আইডিয়া দিতাম। আসিফ সে মতেই সবকিছু অ্যারেঞ্জমেন্ট করাতেন।
আসিফ আকবর ও আপনার মধ্যে এখনো সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। কীভাবে কাজ করছেন? সমন্বয়টা হয় কীভাবে? আপনাদের যোগাযোগের মাধ্যম কি কেবল হোয়াটসঅ্যাপ?
কবীর সুমন: আসিফের সঙ্গে এখনো সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। সমন্বয় নিজেরাই করি। আসিফের সঙ্গে কীভাবে কাজ করা যায়Ñ সেই আইডিয়াটা দিয়েছিলেন আরিফ। কারণ আমি আসিফের গানের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। আমাদের সমন্বয়ের কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই।
আসিফ আকবরের সঙ্গে কাজ করে কেমন লাগছে? কোনো সমস্যা হয় কি?
কবীর সুমন: আসিফ আকবরের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বিন্দুমাত্র কোনো সমস্যা হয়নি বা হচ্ছে না। তিনি চমৎকার একজন মানুষ। আমি পেশাদার, আসিফও পেশাদার একজন মানুষ। পেশাদারিত্বের মধ্যে ভাব-ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই। ভালোবাসা-টালোবাসা দিয়ে কোনো কাজ হয় না। কাজ হয় কাজের লোককে দিয়ে। প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে বড়জোর বাচ্চাকাচ্চা হতে পারে, কিন্তু কাজ হয় না। অনেকেরই ধারণা, গান খুব ইমোশনাল জিনিস। মোটেও না। গান একটা কাজ। বাজনা একটা কাজ। কেউ ভালো রুমালী রুটি বানান, কেউ ভালো কাবাব তৈরি করেন, কেউ ভালো গান বানান। কেউ ভালো গান গান। এর মধ্যে আলাদা কিচ্ছু নেই। আসিফের সঙ্গে আমার একটা স্নেহ, ভালোবাসার সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে। তিনি এখন নিশ্চিন্তে আমার কাছে যেকোনো কথা বলতে পারেন। গানও চাইতে পারেন। বলতে পারেন যে, শ্রদ্ধেয় অগ্রজ, এরকম একটা গান হলে ভালো হয়। আমিও বলতে পারি আদরের অনুজÑএই একটা জিনিস আমি তৈরি করেছি, দেখুন তো, কেমন লাগে।
আসিফ আকবরের বিশেষ কোন গুণটির কথা বলবেন, যা আপনাকে মুগ্ধ করে?
কবীর সুমন: আসিফের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, সোজা কথা সোজাভাবে বলেন। একটা উদাহরণ দিই। একবার একটি ‘রাগ’-এর ভিত্তিতে সুর করে অন্য ধরন বা মেজাজের একটা আধুনিক বাংলা গান তৈরি আসিফকে পাঠিয়েছিলাম। বললাম, দেখুন তো কেমন লাগে? তিনি সরাসরি বললেন, ‘এ আমি পারবো না, আমাকে দিয়ে এটা হবে না। এ জিনিস করে আমার অভ্যাস নেই। আমাকে মার্জনা করেন’। এটা আমার খুব ভালো লাগে। আরিফ বিল্লাহ অনেক সময় আমাকে ভালো ভালো আইডিয়া দেন। ঢাকায় শিশুদের খেলার জায়গার খুব অভাব। ছোট ছেলেমেয়েরা ট্যাবে খেলে। এর উপর যদি গান বানানো যায়। আমি গান বানিয়েছি। ভীষণ ভালো গান। সেটা আসিফ গেয়েছেন। গান লেখার জন্যও আইডিয়া লাগে। আমি তো ঢাকায় থাকি না। যদি থাকতাম তাহলে ওখানকার নানা ইস্যু আমার চোখে পড়তো। বুঝতে পারতাম। অনুভব করতাম। তার ওপর আমি গান তৈরি করতে পারতাম। কেউ আইডিয়া দিলে বাংলাদেশের জন্য গান বানাতে সহজতর হয়।
আসিফ আকবরের গলা বা কণ্ঠ নিয়ে মুগ্ধতা আছে অনেকেরই। আপনি কী বলবেন?
কবীর সুমন: আসিফের কণ্ঠ খুব সুরেলা। কণ্ঠে একটা জোয়ারি বা ঝঙ্কার আছে। জোয়ারি হচ্ছে, তানপুরার একটা ব্রিজ থাকে, তাঁরটা তার ওপর দিয়ে যায়, উপরের কানগুলোচার বা ছয়টি তাঁর ব্রিজের দিয়ে নেমে আসে। এর ফাঁকে সুতোটা দিয়ে জোয়ারি তৈরি হয়। একটা ঝনঝনে, রিনরিনে আওয়াজ আসে। আসিফের গলায় জোয়ারি অসাধারণ। খুব কম লোকের কণ্ঠে আজকাল জোয়ারি পাওয়া যায়। দুই বাংলাতেই এই জোয়ারি আর পাওয়া যায় না। আসিফ অসামান্য জোয়ারির অধিকারী। গমগম করে ওঠে তাঁর কণ্ঠ। বিরল প্রকৃতির গলা আসিফের। পশ্চিমবঙ্গে এরকম দু’জন গায়কের নাম আমি বলতে পারি, যারা সু-গায়ক। একজন রূপঙ্কর, অপরজন রাঘব। শ্রীকান্ত একটু সিনিয়র। নবীনদের মধ্যে রূপঙ্কর ও রাঘবের কথা বলবো। শ্রীকান্ত সুগায়ক। কিন্তু রূপঙ্কর বিশেষ ধরনের কণ্ঠসম্পদের অধিকারী। রাঘবও তাই। আসিফের গলাতেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। আসিফের গলা শুনলেই বোঝা যায়এটা আসিফ আকবর গাইছেন।
আসিফ আকবরের সঙ্গে ইতোমধ্যে বেশকিছু কাজ করেছেন। সম্ভবত ৮টির মতো গান রিলিজ হয়েছে আপনাদের। বাংলাদেশের একজন শিল্পীর জন্য কাজ করছেন, খানিকটা বাংলাদেশের উপযোগী করে লেখা। এটা কি চিন্তাভাবনা করেই করেন, নাকি হয়ে যায়?
কবীর সুমন: সম্ভবত আসিফের জন্য আমি ৮টি গান লিখে সুর করেছি। সাংঘাতিক ব্যাপার। আগেরকার দিন হলে একটা ক্যাসেট বের হয়ে যেতো। বাংলাদেশের জন্য আমার হৃদয়ে বিশেষ একটা জায়গা আছে। যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো, তখন মনে হতো এই যুদ্ধ তো আমারও। বঙ্গবন্ধুকে মনে হতো, আমারই নেতা। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও মুক্তিযোদ্ধা বীর বিক্রম শমসের মবিন চৌধুরী আমার বিশিষ্ট বন্ধু। এর বাইরেও বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে। অনেক কিছু জানতেও পেরেছি। ফলে বাংলাদেশের গন্ধটা আমার কাছে দূরে নয়। বাংলাদেশ আমার কাছে বিদেশ নয়। বাংলাদেশের কারও জন্য যদি আমার কোনো গান তৈরি করতে হয়, প্রথমে আমাকে জানতে হয়গায়ক কী চাইছেন। কী ধরনের তাল, লয়, সুর, ছন্দে গাইতে স্বচ্ছন্দবোধ করবেন তিনি। এটা জানা খুব জরুরি। লিরিক নিয়ে আমি অতোটা ভাবি না।
আপনার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা আছে বলে মনে হয় কি?
কবীর সুমন: আমার সম্পর্কে লোকের কিছু ভুল ধারণা আছে যে আমি বোধহয় নিজের জন্য গান লিখি। সুর করি। ব্যাপারটি একেবারে তা নয়। ভুল ধারণা। আমি কিন্তু অনেকের জন্যই গান তৈরি করি। শুধু নিজের জন্য নয়। দুই বাংলায় আমার টাইপের লোকেরা, যারা প্রায় গণশিল্পীর পর্যায়ে কাজ করেন, একটা গিটার দিয়ে লাখ লাখ মানুষের সামনে গান গাই। হারমোনিয়াম ও তবলা নিয়ে বেশি গান গাইনি, একটা দোতরা, একতারা নিয়ে গান গেয়েছি। কাঙালিনী সুফিয়ার মতো পারফরমার পৃথিবীতে খুব কম আছে। তিনি তো আর গিটার নিয়ে গান করেন না। তার যে টিম, সেখানে হারমোনিয়াম বাজে, ঢোল বাজে, ঢোলক বাজে, তবলা বাজে। কাঙালিনী একজন দুর্ধর্ষ গায়িকা। পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে কাঙালিনী সুফিয়ার মতো কোনো গায়িকা নেই। কাঙালিনী সুফিয়া যদি আমাকে বলতেন দাদা, আমার জন্য একটা গান তৈরি করে দেবেন? তার গলার টাইপ বিবেচনায় নিয়ে আমি একটা গান তৈরি করে বলতাম, দেখো তো, এটা কেমন লাগে, মেয়ে? আমি পেশাদার। বহু লোকের জন্য গান তৈরি করেছি। ভবিষ্যতেও করবো।