৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা-কর্মী। পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের বিশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার বিনিময়ে ভারতের ‘নিরাপদ আশ্রয়’ নিশ্চিত করছেন অনেক প্রভাবশালী বাংলাদেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মেহেরপুর উপজেলার কাশারীবাজার থেকে এক সাংসদের ফোন এসেছিল সীমান্তবর্তী কাথুলিবাজার এলাকায় একটি বাড়িতে। তিনি জানান, দেশের পরিস্থিতি অশান্ত। তাই স্ত্রী এবং চার সন্তানকে নিয়ে কিছু দিনের জন্য দেশ ছেড়ে ভারতে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ চান তিনি। ওই ফোনের কিছুক্ষণ পরে কাথুলিবাজার থেকে ফোন আসে নদিয়ার করিমপুর-২ ব্লকের রাউতবাটি গ্রামে। মিনিট পাঁচেকের কথোপকথন। যিনি আশ্রয় চাইছেন, তার ‘প্রোফাইল’, রাজনৈতিক ঝুঁকি, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি সংক্ষেপে জেনে নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। তাকে জানানো হয়, ভারতে আসতে সাংসদের পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু খরচ পড়বে ভারতীয় মুদ্রায় এক লাখ রুপি।

যতদিন ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ থাকবেন, ততদিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের নজর এড়িয়ে থাকার জন্য দিতে হবে মাসিক ১০ লাখ রুপি। দর কষাকষির পরে ঠিক হয় সীমান্ত পার করাতে দিতে  মাথাপিছু ৭০ হাজার টাকা। আর আশ্রয়ের জন্য মাসিক ৫ লাখ। রাজি হয়ে যান সাংসদ। গত সোমবার রাতে মেহেরপুর সদর থেকে পরিবারকে নিয়ে রওনাও দেন তিনি। বাংলাদেশের গ্রামে এক দিন অপেক্ষার পর গাঁটের কড়ি গুনে দিয়ে কাথুলি এবং কুলবেড়িয়া হয়ে ‘ফেন্সিংহীন’ বাংলার একটি গ্রামে পৌঁছে যান তারা। বাংলাদেশের মইনুদ্দিন (নাম পরিবর্তিত) এবং পশ্চিমবঙ্গের দেবাংশু (নাম পরিবর্তিত) মিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘অপারেশন’ সফল করেছেন

আনন্দবাজার জানায়, বাংলাদেশের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এমন অবৈধ ভাবেই নাকি ভারতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ‘প্রভাবশালীরা’। তাদের নিরাপদে পৌঁছে দিতে কাজ করছে একাধিক চক্র। কেউ নিচ্ছে মাথাপিছু লাখ টাকা, কেউ ৫০ হাজার। বস্তুত, এই চক্র নিয়ে অবহিত বিএসএফ-ও। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জনকে গ্রেপ্তারও করেছে তারা।  

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিবেশী দেশের অশান্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তৈরি হয়েছে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরোনোর নতুন ‘সিন্ডিকেট’। পারাপার এবং আশ্রয়ের জন্য কেউ খরচ করছেন ২ হাজার টাকা (তারা বেশিদিন থাকছেন না), কাউকে দিতে হচ্ছে ২ লাখ টাকা (বেশিদিন থাকার জন্য)। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর্থিক সঙ্গতি এবং সামাজিক পরিচিতি বুঝেই টাকা চাওয়া এবং নেওয়া হচ্ছে।

কাথুলিবাজার এলাকায় ব্যবসা করেন শেখ নাজিম (নাম পরিবর্তিত)। তার কথায়, ‘আমরা এ সব এলাকা হাতের তালুর মতো চিনি। কোথায় কাঁটাতার আছে, কোথায় নেই, সব মুখস্থ। কোথায় পাচারকারী কাঁটাতার কেটে রেখেছে, সেটাও জানি।’’

তিনি আরও বলেন, ‘এই বর্ষায় ভৈরব নদী টইটম্বুর। নদী পুরো খোলা। এ দেশ থেকে যারা ও দেশে (ভারতে) যেতে চাইছে, পরিচিত আর আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে শুধু সীমান্ত পার করিয়ে দিচ্ছি আমরা। বাকি দায়িত্ব ওদের।

পারাপার করাতে কে কত নিচ্ছেন? ব্যবসায়ীর স্বীকারোক্তি, ‘‘ঝুঁকি দুই পক্ষেরই রয়েছে। তাই টাকার ভাগাভাগিও সমান সমান।’’

দেবাংশু বলেন, ‘কাঁটাতার পার হয়ে আমাদের চাষের জমি আছে। রোজ যাতায়াত করি। ওদিক থেকে বেশ কয়েক জন পরিচিত, আত্মীয়-স্বজনেরা ভারতে আসার জন্য মোটা টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা শুধু পার করে এখানে নিয়ে এসেছি। রাখার দায়িত্ব আমাদের নয়। সেটা দেখে অন্য লোক।’

বিএসএফ, পুলিশের নজর এড়াচ্ছেন কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে দেবাংশু বলেন, ‘বিএসএফ এখন খুব সজাগ। সেটা ঠিক। তবে গ্রামে আমাদের সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই কাউকে আশ্রয় দিয়েছি জানলে কেউ মুখ খুলবে না।’’ কিন্তু কাজটা তো অনৈতিক? যুবক এ বার দার্শনিক, ‘‘ও দেশ থেকে যারা আসছে, তারা তো সত্যিই বিপদে পড়েছে। বিপদে মানুষকে আশ্রয় দেওয়া তো মানুষেরই কর্তব্য!’

আনন্দবাজার জানায়, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ‘ঘনিষ্ঠ’ বা সমর্থকেরা এখন বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের নজরে। হাসিনার আমলের অনেক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় লুক-আউট নোটিস দিয়েছে প্রশাসন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, এমন মানুষজনের ক্ষেত্রেও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দেশ ছাড়ার অনুমতি দিচ্ছে না অন্তর্বর্তী সরকার।  তাই যে কোনও ভাবে দেশ ছেড়ে আপাতত এ পারে ঠাঁই নিতে চাইছেন। সেখান থেকেই এই ‘দালাল নির্ভরতা।

news