নো-কিডস জোন’ নিয়ে বিপাকে দক্ষিণ কোরিয়া, ২শ বিলিয়ন ডলার খরচ করেও বৃদ্ধি পাচ্ছে

দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার বিশে^র সর্বনিম্ন। অথচ সে দেশে ‘নো-কিডস জোন’ সংস্কৃতি কি মানানসই। একদিতে দক্ষিণ কোরিয়ার নারীদের আরো সন্তান ধারণ করতে উৎসাহিত করার জন্য শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে অথচ ক্যাফে এবং রেস্তোরাঁর মতো জায়গা থেকে শিশুদের নিষিদ্ধ করার ধারণাটি অনুসরণ করা হচ্ছে। এখন অবশ্য এ দুটিকে কিছুটা বিপরীতমুখী বলেই মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ‘নো-কিডস জোন’ উল্লেখযোগ্যভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শত শত ‘নো-কিডস জোন’ ছড়িয়ে আছে দেশটির আনাচে কানাচে, যার লক্ষ্য মূলত বড়দের জন্য ঝামেলামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। শুধুমাত্র জেজুতে ছুটির দ্বীপে এরকম প্রায় ৮০টি অঞ্চল রয়েছে এবং অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপগুলির মতে, বাকি অঞ্চলগুলোতে চার শতাধিক ‘নো-কিডস জোন’ রয়েছে।  
দেশটির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাগত সমস্যা নিয়ে উদ্বেগের কারণে অনেক জায়গা থেকে শিশুদের সীমাবদ্ধ করার প্রজ্ঞা সম্পর্কে এখন সন্দেহ জাগতে শুরু করেছে।

বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের পাশাপাশি, দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশ্বের দ্রুততম বার্ধক্য জনসংখ্যার মত সমস্যা রয়েছে। গত বছর, দক্ষিণ কোরিয়ার সন্তান জন্মদানে উর্বরতার হার ০.৭৮ শতাংশ যা রেকর্ড সর্বনিম্নে নেমে এসেছে - এমনকি স্থিতিশীল জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় ২.১ এর অর্ধেকও নয় এবং বর্তমানে তা জাপানের (১.৩) থেকেও অনেক কম। তরুণ দক্ষিণ কোরিয়ানরা ইতিমধ্যেই একাধিক ফ্রন্টে চাপের সম্মুখীন - আকাশ-উচ্চ রিয়েল এস্টেট খরচ এবং দীর্ঘ কর্ম সপ্তাহ থেকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উদ্বেগ যা দেশটির নাগরিকদের সন্তান নিতে উদ্বুদ্ধ করে না। একটি পরিবার শুরু করার বিষয়টি নিয়ে তাদের তা দুবার ভাবতে বাধ্য করে। অথচ গত ১৬ বছরে দেশটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্যে ২০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যাতে আরও বেশি লোককে সন্তান নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা যায়। সমালোচকরা পরামর্শ দেন যে, সমস্যায় বেশি অর্থ নিক্ষেপ করার পরিবর্তে, তরুণদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য কাজ করা দরকার।

সমীক্ষায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে বেশিরভাগ দক্ষিণ কোরিয়ানরা নো-কিডস জোনকে সমর্থন করে, এই মানসিকতা পরিবর্তন করা সহজ হবে না। কিন্তু মতামত পরিবর্তন হতে পারে এমন লক্ষণও আছে। অনেকে ‘নো-কিডস জোন’ নীতি মানতে নারাজ। ইয়ং হাই-ইন নামে একজন মা এবং বেসিক ইনকাম পার্টির একজন আইন প্রণেতা, তারা দুজনেই তাদের ২ বছরের ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির একটি মিটিংএ যেখানে বাচ্চাদের সাধারণত অনুমতি দেওয়া হয় না। তিনি ওই অনুষ্ঠানে সমবেত আইনপ্রণেতাদের বলেন, বাচ্চাদের সাথে দৈনন্দিন জীবন সহজ নয়, এই সময় তিনি তার ছেলেকে আলিঙ্গন করেন এবং তাকে মঞ্চের চারপাশে ঘুরতে দেন। তিনি বলেন, আমাদের সমাজকে এমন একটি সমাজে পুনর্জন্ম দিতে হবে যেখানে শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আইনপ্রণেতার এই বক্তব্য সারা বিশ্বে মিডিয়া কভারেজ পেয়েছিল।

কোরিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে একটি পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে জেজু দ্বীপ, সম্প্রতি এ অঞ্চলে নো-কিডস জোন বাতিলে একটি বিল নিয়ে বিতর্ক চলছে। দ্বীপটির  প্রাদেশিক পরিষদের এই পদক্ষেপ ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে এসেছে যে পর্যটন-নির্ভর দ্বীপে অনেক গেস্টহাউস এবং ক্যাম্পসাইটে নো-কিডস জোন বরং আতিথেয়তার জন্য দেশটির সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বনি টিল্যান্ড, যিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতিতে বিশেষজ্ঞ, তিনি বলেছেন, যেসব শিশুর পরিবার ছুটিতে জেজুতে ভ্রমণ করে তারা অসন্তুষ্ট হয় কারণ একটি মনোরম ক্যাফেতে সন্তানদের যাওয়ার অনুমতি না থাকায় তাদের শুধু গাড়ি চালিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হয়। অন্যান্য সমালোচকরা বলছেন যে নো-কিডস জোনের মত সমস্যাটি ব্যবসা হারানোর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কেউ কেউ নো-কিডস জোনকে বয়স বৈষম্যের একটি অযৌক্তিক কাজ হিসেবে দেখেন যা কোরিয়ান সংবিধানের পরিপন্থী।

২০১৭ সালে, কোরিয়ার ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন বলতে শুরু করে যে নো-কিডস জোন সমতার অধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং এই অনুশীলন বন্ধ করার আহ্বান জানাতে থাকে। এটি দেশটির সংবিধানের ১১ ধারা উদ্ধৃত করে বলেন,  নো-কিডস জোনের মত ব্যবস্থা লিঙ্গ, ধর্ম বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করেন এবং জাতিসংঘের একটি কনভেনশন অনুযায়ী কোন শিশুর সাথে এমন অন্যায় আচরণ করা উচিত নয়। জেজুতে একটি ইতালীয় রেস্তোরাঁ থেকে এমন আচরণ পাওয়ার পর তিন সন্তানের এক বাবা নো-কিডস জোন তুলে দেওয়ার একটি আবেদনের প্রতিক্রিয়ায় এই রায় আসে। তবে এটি আইনত বাধ্যতামূলক নয় এবং সমালোচকরা বলছেন যে নো-কিডস জোনের চলমান জনপ্রিয়তা তুলে ধরে মানুষের এমন মানসিকতা পরিবর্তন করা খুব কঠিন হবে।

নো-কিডস জোন এখনো দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি পরিচিত দৃশ্য। সাধারণত ক্যাফে, কিছু রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য ব্যবসায়ও এটি বেশ জনপ্রিয়। ২০২১ সালে হ্যানকুক রিসার্চের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ১০ জনের মধ্যে ৭ জনের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক এটির পক্ষে। শুধু কেবল নিঃসন্তান প্রাপ্তবয়স্করাই যে এ ব্যবস্থা সমর্থন করে তা নয় দক্ষিণ কোরিয়ায়, শান্তি এবং শান্ত থাকার অধিকার এত ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে এমনকি অনেক পিতামাতাও জোনটিকে যুক্তিসঙ্গত এবং ন্যায়সঙ্গত হিসাবে দেখেন।

লি ই-রং দুই বছর বয়সী এক ছেলের মা। তিনি বলেন, যখন আমি আমার সন্তানের সাথে বাইরে থাকি, তখন আমি এমন অনেক পরিস্থিতি দেখি যা আমাকে ভ্রুকুটি করতে বাধ্য করে। তিনি বলেন, এমন বাবা-মাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন নয় যারা তাদের সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করে না, এধরনের পরিস্থিতি বরং অন্যান্য লোকেদের ক্ষতি করে। এজন্যে হয়ত নো-কিডস জোন রয়েছে।

সিউলের দুই সন্তানের মা লি জি-ইউন লি’র সঙ্গে একমত। তিনি মনে করেন এটি ব্যবসায়িক মালিকদের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু সব বাবা-মা এতটা বোঝে না। সেউলের কিম সে-হি নামের মা যিনি বলেন, নো-কিডস জোন সাইন দেখলে মনে আক্রমণ বোধ করি। মায়েদের প্রতি এ ধরনের ব্যবস্থা বরং একধরনের ঘৃণা তৈরি করে। জেজুতে, ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড বা গেস্ট হাউসে চিহ্নগুলি দেখা অস্বাভাবিক নয় যে অতিথিদের জন্য নিম্ন এবং উচ্চ উভয় বয়সের সীমা নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘নো-টিনএজার জোন’ এবং ‘নো-সিনিয়র জোন’এর মত কিছু বিশেষ অঞ্চল রয়েছে।

 নো-র‌্যাপার জোন কিংবা নো-ইউটিউবার জোন এমনকি নো-প্রফেসর জোনও রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০ ৩০ দশকে কোলাহলপূর্ণ শিশুদের অপছন্দ থেকেই এধরনের নো-কিডস জোন গড়ে উঠেছে। কিন্তু দেশটির জনসংখ্যার সমস্যাগুলির সমাধানে এই ধরনের মানসিকতাগুলি পুনরায় পরীক্ষা করা দরকার। কারণ তরুণ নারীদের সন্তান ধারণে অনিচ্ছার এটি একটি কারণ। সূত্র: ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা

 এনবিএস/ওডে/সি

news