ভারতীয় রাজনীতি:  অনাস্থার দীর্ঘ ইতিহাস, পাশ হয়েছে মাত্র একটি

বুধবার লোকসভা নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। যা মণিপুর ইস্যুতে চাপ বাড়াতে কংগ্রেস পেশ করেছে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এটি হচ্ছে ২৮তম অনাস্থা প্রস্তাব। আজ অবধি, এই প্রস্তাবগুলির মধ্যে একটি মাত্র পাস হয়েছে। যার ফলে একটি সরকারের পতন ঘটেছিল। সেটা ১৯৭৯ সালে মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার পড়ে গিয়েছিল অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটির জেরে। ১৯৫২ সালে লোকসভার নিয়ম অনুসারে ৩০ জন সাংসদের সমর্থনে একটি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা যেতে পারে। সংখ্যাটা বেড়ে এখন ৫০ হয়েছে। তবে, প্রথম দুটি লোকসভার মেয়াদে একটিও অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়নি। 

নেহরুর সময়ে অনাস্থা প্রস্তাব: ১৯৬৩ সালে তৃতীয় লোকসভা চলার সময়, জওহরলাল নেহরু সরকারের বিরুদ্ধে আচার্য জেবি কৃপালানি প্রথম অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক ২১ ঘণ্টা এবং চার দিন ধরে চলেছিল। ৪০ জন সাংসদ তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার উত্তরে, নেহেরু মন্তব্য করেছিলেন, ‘একটি অনাস্থা প্রস্তাবের লক্ষ্য সরকারে থাকা দলটিকে সরিয়ে দেওয়া এবং তার জায়গা নেওয়া। বর্তমান এটা স্পষ্ট যে এমন কোন প্রত্যাশা বা আশা প্রস্তাবকারীদের ছিল না। যদিও এই প্রস্তাব বিভিন্ন কারণে রীতিমতো আকর্ষণীয়। আর, লাভজনকও বটে। কিন্তু, আমি মনে করি যে একটু অবাস্তব উদ্দেশ্যে এই প্রস্তাব আনা হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে, আমি এই প্রস্তাব এবং এই বিতর্ককে স্বাগত জানিয়েছি। আমি অনুভব করেছি যে আমরা যদি এই ধরণের পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষা করি তবে এটি একটি ভাল ব্যাপার হবে।’

শাস্ত্রীর সময়ে অনাস্থা প্রস্তাব: পরবর্তী অনাস্থা প্রস্তাব মোটামুটি একবছর পরে ১৯৬৪ সালে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্দল সাংসদ এনসি চ্যাটার্জি উত্থাপন করেছিলেন। তাঁর সেই প্রস্তাবটি অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর আলোচনা ইস্যুতে রীতিমতো দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল। দীর্ঘতম সময় এই বিতর্ক চলেছিল। সময় ছিল ২৪ ঘণ্টা। তাঁর বক্তব্যে এনসি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংকট আছে। সত্যি বলতে, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে এবং এর জন্য আমি এই সরকারকে প্রধানত দায়ী করি।’

ইন্দিরার সময়ে অনাস্থা প্রস্তাব: ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে, লোকসভায় ১৫টি অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। তার মধ্যে তিনটি হয়েছিল লালবাহাদুর শাস্ত্রীর বিরুদ্ধে। আর, ১২টি অনাস্থা প্রস্তাব পেশ হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে। ইন্দিরা ১৯৮১ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে আরও তিনটি অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে, এর কোনওটিই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হয়নি। সিপিএম এমপি জ্যোতির্ময়ী বসু ইন্দিরার বিরুদ্ধে পরপর চারবার অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন নভেম্বর ১৯৭৩, মে ১৯৭৪। আবার দুই মাস পরে জুলাই ১৯৭৪ এবং ১৯৭৫ সালের মে মাসে।

প্রথম সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা: প্রথম অনাস্থা প্রস্তাব যা একটি সরকারকে পতনের দিকে পরিচালিত করেছিল সেটা উঠেছিল ১৯৭৯ সালে। সেবছর কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন যশবন্তরাও বলবন্তরাও চ্যাবন। দুই দিন ধরে, নয় ঘণ্টার বিতর্কের পর, প্রস্তাবটি নিয়ে ভোটাভুটির আগেই দেশাই পদত্যাগ করেন। দেশাই তার একবছর আগে ১৯৭৮ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস দলের সিএম স্টিফেনের আনা অনাস্থা প্রস্তাবেরও মুখোমুখি হয়েছিলেন।

রাজীব-নরসিমহা রাওয়ের জমানায় অনাস্থা: এরপর থেকে প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীই অনাস্থা প্রস্তাবকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছেন। রাজীব গান্ধীও ১৯৮৭ সালে এমন একটি অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হয়েছিলেন। লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তাঁর অবশ্য কোনও অসুবিধা হয়নি। তিনি ধ্বনি ভোটে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। যাইহোক, দশম লোকসভায় পিভি নরসিমহা রাও তাঁর মেয়াদে দুটি অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন যশবন্ত সিং। সেই প্রস্তাব ৪৬ ভোটে পরাজিত হয়েছিল। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। এই প্রস্তাবকে পরাজিত করতে রাও অবশ্য কোনও সমস্যায় পড়েননি। ১৪ ভোটের ব্যবধানে রাও যে তৃতীয় অনাস্থা প্রস্তাবকে পরাজিত করেছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সাংসদদের ভোট দেওয়ার জন্য ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়েছিল। এরপর ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কংগ্রেস সাংসদ সোনিয়া গান্ধীর আনা অনাস্থা প্রস্তাবকে পরাজিত করেছিলেন।

এর আগে, শেষ অনাস্থা প্রস্তাব পেশ হয়েছিল ২০১৮ সালে। সেই সময় অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) তাঁর রাজ্যের জন্য বিশেষ বিভাগের মর্যাদার দাবিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) ত্যাগ করেছিলেন। সেই বছরের বাদল অধিবেশনে ১২ ঘণ্টা বিতর্কের পরে, ২০ জুলাই মোদি সরকার লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাবকে ১৯৯ ভোটে পরাজিত করেছিল। ১২৬ জন সদস্য প্রস্তাবকে সমর্থন করলেও ৩২৫ জন সাংসদ তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। নিম্নকক্ষে দিনব্যাপী অধিবেশনে সরকার এবং বিরোধীদের পারস্পরিক অভিযোগ রীতিমতো নাটকীয়তা তৈরি করেছিল। সেটা চরমে উঠেছিল যখন তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতার পরে, মোদির কাছে গিয়েছিলেন এবং তাকে আলিঙ্গন করেছিলেন।

গত অনাস্থায় মোদির ভূমিকা: তার সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটকে বিরোধীদের ‘অহংকার’-এর ফল বলে অভিযোগ করেছিলেন। মোদি এর আগে সমস্ত দলকে অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘মোদি হটাও (মোদি সরান)’ মানসিকতা নিয়ে কাজ করার অভিযোগ করেছিলেন। তার প্রস্তাবের ওপর বিতর্কের জবাবে মোদি অভিযোগ করেছিলেন, ‘কিছু লোক নেতিবাচক রাজনীতি’ করছে। লোকসভায় তাঁর চেয়ারের কাছে হেঁটে যাওয়ার পরে আলিঙ্গনের জন্য দাঁড়াতে বলায় তিনি রাহুল গান্ধীকেও কটাক্ষ করেছিলেন। মোদির অভিযোগ ছিল যে, তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি তার আসন দখল করতে তাড়াহুড়ো করছেন বলেই তার মনে হয়েছে। বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘শুধুমাত্র দেশের নির্বাচকরাই তাঁর ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেন এবং তাকে তার চেয়ারে বসাতে পারেন।’ মোদি এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তাড়াহুড়ো কেন?’ প্রধানমন্ত্রী যখন তার এই বক্তব্য রাখছিলেন, সেই সময় রাহুল গান্ধী সংসদে উপস্থিত ছিলেন।সূত্র: ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা

এনবিএস/ওডে/সি

news