ভারতের পাঞ্জাবে কেন খালিস্তানপন্থীদের উত্থান?

ভারতে চণ্ডীগড়ের থিঙ্কট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনের অধিকর্তা প্রমোদ কুমার মনে করেন যে পাঞ্জাবের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের উদাসীনতাই খালিস্তানপন্থীদের জনপ্রিয়তা বাড়ার একটা কারণ। 

জ্বলন্ত রাজনৈতিক সমস্যাগুলির অন্যতম হচ্ছে শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘গুরু গ্রন্থ সাহেব’ অপবিত্র করার সর্বশেষ যে ঘটনাগুলি হয়েছিল ২০১৫ সালে, সেগুলির বিচার এখনও শেষ না হওয়া।
ওই ঘটনায় যে গণবিক্ষোভ হয়েছিল, পুলিশ সেখানে গুলি চালায় এবং দুজন বিক্ষোভকারী নিহত হন।

আগেও বেশ কয়েকবার শিখদের ধর্মগ্রন্থ অপবিত্র করার ঘটনা হয়েছে, তা নিয়ে বিক্ষোভ এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা হয়েছে। কিন্তু ২০১৫ সালে পরপর তিনবার গুরু গ্রন্থ সাহেব অপবিত্র করার ঘটনা সামনে আসে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন ওই ঘটনাক্রম, পুলিশের গুলি-চালনায় মৃত্যুর ফলে পাঞ্জাবের শিখ ধর্মাবলম্বীরা এতটাই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে দুবছর পরে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শিরোমণি আকালি দল ও বিজেপির জোট সরকারের পতন হয়।

প্রমোদ কুমারের কথায়, “ধর্মগ্রন্থ অপবিত্র করার ঘটনায় ন্যায় বিচার না পাওয়া এবং সেসব ঘটনায় যেসব শিখ বন্দির কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তারা মুক্তি না পাওয়ার বিষয়গুলি সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। এর ফলেই অমৃতপাল সিং এবং সরবজিৎ সিং খালসাদের মানুষ ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন।"

পাঞ্জাবের গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুগুলো মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। অনেক মিছিল-মিটিং করেছেন মানুষ, কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা এটা নিয়ে উদাসীনই থেকে গেছেন,” বলছিলেন প্রমোদ কুমার।

তার ব্যাখ্যা, তাই মানুষ বিরক্ত হয়ে মূল ধারার রাজনৈতিক নেতাদের পরিবর্তে এমন সংসদ সদস্য বেছে নিলেন, যারা কিছুটা চরমপন্থী রাজনীতির কথা বলেন।

নির্বাচনের আগে সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ঠিক এই বিষয়গুলোই উত্থাপন করেছিলেন লোকসভার সদ্য নির্বাচিত বিয়ন্ত সিংয়ের পুত্র সরবজিৎ সিং এমপি।
‘ওয়ারিস পাঞ্জাব-দি’ এবং অমৃতপাল সিং: সরবজিৎ সিংয়ের মতোই যে আরেক খালিস্তানপন্থী নেতা এবার এমপি হয়েছেন, সেই অমৃতপাল সিংকে ‘ভিন্দ্রানওয়ালে ২.০’ বলে ডাকা হয়ে থাকে।

জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে একজন শিখ ধর্মগুরু ছিলেন এবং তিনিই পৃথক খালিস্তানের দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যা খালিস্তান আন্দোলন বলে পরিচিত।

কট্টরপন্থী শিখ ধর্ম-কেন্দ্র ‘দমদমি তাকশাল’এর জাঠেদার বা ধর্মগুরু ছিলেন জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে। 

শিখদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৮৪ সালে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামের যে অভিযান চালিয়েছিল, সেই সময়েই গুলিযুদ্ধে নিহত হন জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে।

 ওই সেনা অভিযানের বদলা নিতেই সরবজিৎ সিংয়ের বাবা বিয়ন্ত সিং এবং তারই সহকর্মী সতওয়ান্ত সিং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিলেন।
কেন গ্রেফতার হন অমৃতপাল সিং? পাঞ্জাবের মানুষ ২০২২ সালের আগে অমৃতপাল সিংয়ের নামই শোনেননি।

অমৃতসরের কাছে জাল্লুপুর খেড়া গ্রামের এই যুবক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই বছর-দশেক আগে পরিবারের পরিবহন ব্যবসা দেখতে দুবাই পাড়ি দিয়েছিলেন। ভারতের পাসপোর্টধারী হলেও তিনি কানাডারও পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট।

অমৃতপাল সিং ভারতে ফিরে আসেন ২০২২ সালে, আর সে বছরই ২৯শে সেপ্টেম্বর ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব-দি’ সংগঠনের একটি গোষ্ঠী তাদের নতুন নেতা হিসাবে তাকে বেছে নেয়।

গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই অমৃতপাল সিংয়ের বেশ কয়েকশো সশস্ত্র অনুগামী অমৃতসরের কাছে আজনালাতে তাদের এক সহকর্মীকে ছাড়িয়ে আনতে পুলিশ থানায় আক্রমণ চালায়। হামলার সময় তাদের মুখে ছিল খালিস্তানের স্লোগান।

 আগ্নেয়াস্ত্র ও কৃপান নিয়ে চালানো সেই হামলায় বহু পুলিশ কর্মী ও কর্মকর্তা আহত হন।
পাঞ্জাব পুলিশ প্রায় এক মাস ধরে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে অমৃতপাল সিংকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। তাকে ধরার জন্য তারা এমন কী পাঞ্জাবের বেশ কিছু এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দিয়েছিল।

গ্রেপ্তারের পরে তাকে আসামের ডিব্রুগড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে আগে থেকেই বন্দি ছিলেন অমৃতপাল সিংয়ের কয়েকজন সহযোগী।

সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একাধিক সাক্ষাৎকারে ও বক্তৃতায় এই তরুণ নেতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি গুরু ভিন্দ্রানওয়ালের মতোই খালিস্তানের পক্ষে লড়ে যাবেন। তাঁর ধর্মীয় বক্তৃতা শুনতে সভায় প্রচুর ভিড়ও হত।

সম্প্রতি নতুন করে যে খালিস্তানপন্থীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন, তাদের কাছে ‘হিরো’র মর্যাদা পান সদ্য এমপি হওয়া অমৃতপাল সিং।

 অমৃতপাল সিং নিজে অবশ্য নিজে ভোটের প্রচারে নামতে পারেন নি, কারণ তিনি সন্ত্রাস দমন আইনে অভিযুক্ত হয়ে আসামের ডিব্রুগড় জেলে আটক হয়ে আছেন।

 রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন গত বছর অমৃতপাল সিং এবং তার সহযোগীদের যে ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তা নিয়েও মানুষের মনে ক্ষোভ আছে, যা ভোটযন্ত্রে প্রতিফলিত হয়েছে।

পরবর্তীতে পাঞ্জাব সরকার অমৃতপাল সিংয়ের অনেক সহযোগীকে মুক্তি দিলেও তাদের ওপরে হেফাজতে যে অত্যাচার করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে, সেটাও মানুষের ক্ষোভের একটা কারণ। সূত্র: ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা

এনবিএস/ওডে/সি

news