ভারতের তরুণ প্রজন্ম বা জেনারেশন জেড (জেন-জি) বিশ্বের সবচেয়ে বড় তরুণ জনগোষ্ঠীর অন্যতম। দেশটির ৩৭ কোটিরও বেশি মানুষ এখন ২৫ বছরের নিচে, যা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে তারা আগের যেকোনো প্রজন্মের তুলনায় বেশি সচেতন, সংযুক্ত এবং রাজনৈতিকভাবে অবহিত। তারা জানে দেশে কীভাবে দুর্নীতি চলছে, বৈষম্য কীভাবে বাড়ছে এবং রাজনীতির খেলা কোথায় গড়াচ্ছে। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—এই বিশাল, তেজি, সচেতন তরুণ সমাজ কেন রাজপথে নেই?

ভয়ের দেয়াল: প্রতিবাদের নামে 'রাষ্ট্রবিরোধী' তকমা

ভারতের তরুণদের রাস্তায় না নামার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ভয়। ভারতে রাজপথে নামা মানেই সঙ্গে সঙ্গে 'রাষ্ট্রবিরোধী' বা 'অ্যান্টি-ন্যাশনাল' তকমা জুটে যাওয়া। ২৩ বছরের শিক্ষার্থী ধৈর্য চৌধুরী বলেন, এখনকার প্রজন্ম জানে কী হচ্ছে, কিন্তু প্রতিবাদের চিন্তা করলেই ভয় কাজ করে। কারণ, যেকোনো মতভেদকেই এখন দেশবিরোধিতা হিসেবে দেখা হয়। মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের একাংশ এই লেবেলটিকে ব্যবহার করছে ভিন্নমত দমন করতে।

একসময় যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল রাজনৈতিক বিতর্ক ও আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র—যেমন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ), জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়—সেগুলোতেও এখন প্রতিবাদ নিষিদ্ধ বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।

২৩ বছর বয়সি গবেষক হাজারা নাজিব বলেন, 'এই প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। এখন সেই স্পিরিট হারিয়ে গেছে।'

বিভক্ত তরুণ প্রজন্ম: একমুখী নয় ক্ষোভ

ভারতের তরুণদের ক্ষোভ একমুখী নয়, বরং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা ইস্যুতে। কারও দাবি চাকরির সুযোগ, কারও লড়াই জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আবার কেউ লড়ছে ভাষা ও আঞ্চলিক অধিকারের জন্য। ফলে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলন গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

বিহারের তরুণ সাংবাদিক বিপুল কুমার বলেন, 'ভারতে ক্ষমতা যেমন বিকেন্দ্রীভূত, তরুণদের ক্ষোভও তাই। আমাদের মধ্যে কেউ কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়, আবার কেউ শুধু সরকারি চাকরি চায়। তাই এক মঞ্চে সবাইকে পাওয়া যায় না।'

‘সেন্টার ফর ইয়ুথ পলিসি’র পরিচালক সুধাংশু কৌশিক মনে করেন, ভারতের জেন-জি কখনোই নেপাল বা বাংলাদেশের মতো রাস্তায় নামবে না। কারণ এখানে তরুণ সমাজ অঞ্চল, ভাষা ও জাতি—সব দিক থেকেই বিভক্ত। কৌশিক প্রশ্ন তোলেন, 'ভারতে যদি তরুণ বিদ্রোহ হয়ও, সেটা কি হবে দলিত জেন-জির, না শহুরে তরুণদের, না তামিল ভাষাভাষীদের?'

প্রতিবেশীদের উদাহরণ ও ভারতের নীরবতা
ভারতের এই নীরব তরুণ প্রজন্মের বিপরীতে, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশেই জেন-জি এখন রাজনীতির কেন্দ্রে।

নেপালে: গত মাসেই তরুণদের আন্দোলনে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সরকার পতন হয়।

মাদাগাস্কারে: তরুণদের নেতৃত্বে ক্ষমতা পরিবর্তন ঘটে।

ইন্দোনেশিয়ায়: চাকরির সংকট ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তরুণদের বিক্ষোভে সরকার বাধ্য হয় ছাড় দিতে।

বাংলাদেশেও: ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার ও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন ঘটে।

এই আন্দোলনগুলো ছিল দ্রুত, বিকেন্দ্রীভূত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগঠিত ও অত্যন্ত কার্যকর। অথচ ভারতে সেই আগুনের স্ফুলিঙ্গও দেখা যায় খুব কম।

পূর্বের অভিজ্ঞতা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা
আশির দশকে ইন্দিরা গান্ধীবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০১০ সালের আনা হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন কিংবা ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বিরোধী আন্দোলন—সব জায়গায় তরুণরাই ছিল অগ্রভাগে। কিন্তু সিএএ আন্দোলনের পরিণাম ছিল ভয়াবহ—পুলিশি দমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান, এমনকি ছাত্রনেতা উমর খালিদের মতো ব্যক্তির গ্রেফতার, যিনি এখনও কারাগারে।

স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তরুণ কর্মকর্তা জতিন ঝা বলেন, সরকার প্রতিবাদকে এমনভাবে 'অপরাধ' বানিয়ে ফেলেছে যে, এখন কেউ ভাবতেই পারে না রাস্তায় নামবে।

ভারতের অর্থনীতি তুলনামূলক স্থিতিশীল হলেও তরুণদের বেকারত্ব ভয়াবহ। অনেকেই ভালো সুযোগের খোঁজে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। মাত্র ৩৮ শতাংশ ১৮ বছর বয়সি তরুণ ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলছে।

তবুও ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির প্রতি তরুণদের একটি বড় অংশের সমর্থন অটুট—২০১৯ সালের নির্বাচনে ৪০ শতাংশ তরুণ তাদের ভোট দিয়েছিল, ২০২৪-এও সেই হার খুব একটা কমেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় আজ তরুণদের রাজনৈতিক অবস্থানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

সমাজতত্ত্ববিদ দীপঙ্কর গুপ্তর ভাষায়, 'তরুণ শক্তি ক্ষণস্থায়ী। প্রতিটি প্রজন্ম নিজস্ব ইস্যু নিয়ে ওঠে, পুরোনো আন্দোলনের উত্তরাধিকার নেয় না।' তাই ভারতের জেন-জি আজ হয়তো নীরব, কিন্তু উদাসীন নয়। তারা দেখছে, শিখছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই প্রজন্মের প্রতিবাদ এখন হয়তো রাস্তায় নয়, বরং অনলাইনে, আলোচনায়, কিংবা ভোটের বাক্সে। তবে তাদের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট—একটি ন্যায্য, দুর্নীতিমুক্ত, সমতার ভারত।

তারা হয়তো এখনো রাস্তায় নামেনি, কিন্তু তাদের নীরবতা কোনো আত্মসমর্পণ নয়—এ এক অপেক্ষা, যথাযথ সময়ের অপেক্ষা।

 

news