-: মোঃ আবদুল জলিল :- প্রকাশিত: ০৯ জুন, ২০২২, ১০:০৬ এএম
বিগত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইউরোপের দেশ ইউক্রেন আক্রমন করে অন্যতম শক্তিধর দেশ রাশিয়া। ইউক্রেনকে “ অসামরিকীকরণ ও ডিনাজিফাই” করার জন্য “বিশেষ সামরিক অভিযান” নাম দিয়ে শুরু করা ভ্লাদিমির পুতিনের এ যুদ্ধকে ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশেগুলো সামরকি আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করছে। ইতোমধ্যেই রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের ১০০ দিন পার হয়েছে গত ৩ জুন । এ যুদ্ধে ঊভয় পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি ও হতাহাতের খবর এসেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৬৮ লাখ মানুষ। বিশ্ব অর্থনীতিতেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে চলমান রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ। এ একশ’ দিনে ইক্রেনের প্রায় ২০% ভূমি দখলে নিয়েছে রাশিয়া। যদিও শক্তিধর রাশিয়ার বিরুদ্ধে একশ’ দিন লড়াই করে টিকে থাকাকে ইউক্রেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে অনেকে। ইউক্রেনের প্রেসিডিন্টে ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন. “আমরাই বিজয়ী হবে।” এদিকে ইউক্রনকে অস্ত্র- রসদ দিয়ে সাহায্য করছে ইউরোপ- আমেরিকা। যদিও যুদ্ধ শুরুর পরে ইউরোপ- আমেরিকার সরাসরি সাহায্য না পাওয়ায় হতাশ হয়েছিলেন জেলেনস্কি।
সম্প্রতি ইউরোপের অনেক দেশ ও আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে দেয় সামরিক সহায়তার পরিমান বৃদ্ধি করেছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক ও বিধ্বংসি এম-১৪২ রকেট সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছেন। এতে রাশিয়া ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে “অপ্রত্যাশিত পরিনতির” হুমকি দিয়েছে। এরআগে ২৭ ফেব্রæয়ারি পশ্চিমাদের ইউক্রেন যুদ্ধে না জড়ানোর জন্য রাশিয়ার পারমানিবক শক্তিকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকর নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন পর্যন্ত আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের দেশগুলো ইউক্রেনকে যে সব অস্ত্র দিয়েছে তার তুলনায় এম-১৪২ হাই মবিলিটি আর্টিলারি সিস্টেম (এইচএমএআইএস) অনেক হুমকি তৈরী করবে। রাশিযার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেগ্রেই লাভরভ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়াতে এটা হবে মারাত্মক একটি পদক্ষেপ”। রাশিয়ার অভ্যন্তরে আঘাত হানতে স্বক্ষম এম-১৪২ তথা হিমারস দ্বারা রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করলে রাশিয়া পাল্টা আঘাত স্বরূপ পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের দিকে গেলে যুদ্ধের ভয়াবহতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। অতিসম্প্রতি রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এত দিন ধরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের যে হুমকি দিয়ে আসছিলেন, তার পক্ষে জোরালো সমর্থনের কথা জানালেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ।
ইউক্রেনে চলমান রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে কিয়েভে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক রকেট পাঠানোর সংবাদ প্রকাশের পরপরই রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনীর মহড়ার করা হয়েছে গত ১ জুন। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স - প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ইন্টারফ্যাক্স জানিয়েছে, মস্কোর উত্তর-পূর্বে আইভানোভো প্রদেশে রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনী মহড়ায় অংশ নিয়েছে সামরিক বাহিনীর প্রায় ১ হাজার সদস্য ও ১০০টিরও বেশি যুদ্ধযান। মহড়ায় ওয়াইএআরএস আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকযানও ব্যবহার করা হয়। ধ্বংসাত্মক পারমানবিক যুদ্ধের হুমকির মুখে পরেছে পৃথিবী।
পারমানকিব যুদ্ধের হুমকি থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে হবে। আমরা দেখি অথবা না দেখি সবসময় মৃত্যু ভয়ে কম্পমান পৃথিবী। পারমানবিক অস্ত্রের আঘাতে যেকোন সময়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে পুরো পৃথিবী। বর্তমানে বিশ্বে যে পরিমাণ পরমাণু বোমা মজুদ আছে তা দিয়ে গোটা বিশ্বকে ৩৮ বার পুরোপুরি ধ্বংস করা যাবে বলে জানিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসইপিআরআই)।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার নিক্ষিপ্ত দু’টি আনবিক বোমার বিস্ফোরণে জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে । লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যান নামক বোম দু’টি আঘাতে তাৎক্ষণিকভাবে মারা গিয়েছিল প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ এবং আয়নাইজিংয়ের ফলে ধীরে ধীরে আরো অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছিল। ৭৭ বছর পূর্বের লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যানরা এখন হাজার গুন বেশী শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক। আর তাদের সংখ্যাও অনেক বেশী। তাইতো প্রায় আট শ’ কোটি মানুষের আবাস একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী আজ তার বুকে আশ্রিত প্রাণীকূলসহ ধ্বংসের আশংকায় আর্তনাদ করছে। কিন্তু সে আর্তনাদ কি শুনতে পাচ্ছেন ভায়াবহ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বিশ্ব মোড়ল দেশগুলোর ক্ষমতাধররা?
গত ২০ এপ্রিল ২০২২ সারমাত নামক একটি ভয়ংকর আন্ত:মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায় রাশিয়া। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষেপণাস্ত্রটি রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমের প্লেসেটস্ক থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। পরে এটি প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পূর্বঞ্চলের কামচাটকা উপদ্বীপে নিধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। নতুন এ ক্ষেপণাস্ত্রটি সর্বোচ্চ কৌশলগত এবং প্রযুক্তিগত বৈশিষ্টসম্পন্ন। মার্কিন কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী নতুন এই আন্ত:মহাদেশীয় সারমাত ক্ষেপনাস্ত্রটি একসঙ্গে ১০টি বা তারও বেশী পারমানবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।
২০১৭ সালে সামরিক মহড়া চলাকালে এক ভয়ংকর শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালায় রাশিয়া। শয়তান-২ বা আরএস-২৮ নামের এই ক্ষেপনাস্ত্র হিরোশিমায় নিক্ষেপিত মার্কিন আনবিক বোমার চেয়ে হাজার গুন বেশি শক্তিশালী। আকাশে ৩ হাজার ৮শ’ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ক্ষেপনাস্ত্রটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। ৪০ মেগাটন ক্ষমতাসম্পন্ন এ ক্ষেপনাস্ত্রের সঙ্গে ১২টি নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড যুক্ত করা সম্ভব। এক হামলায় পুরো যুক্তরাজ্য, টেক্সাস অথবা ফ্রান্স ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এই বোমার আঘাতে। ২০১৭ সালে ২০ অক্টোবর ওয়াশিংটন পোস্টে এ্যানা ফিল্ড’র ‘পারমানবিক বোমার ৬টি পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পর উত্তর কোরিয়ার পাহাড় ক্লান্ত’ শীর্ষক অনলাইন প্রতিবেদনে বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বলা হয়, ৭২০০ ফুট উচ্চতার চূড়া বিশিষ্ট ম্যানটাপ পাহাড়ের( Mount Mantap ) নিচে উত্তর কোরিয়া অনেকগুলো পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এতে ম্যানটাপ পাহাড়টি ‘ক্লান্ত পাহাড় উপসর্গ’- এ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-কম্পণবিদ পল জি. বলেন, ‘‘রিচার্ডস সর্বশেষ পারমানিক বিস্ফোরণের পর থেকে পাহাড়টিকে স্থানচ্যূত মনে হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ পারমানবিক পরীক্ষারর সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণে দেশেটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৬.৯ মাত্রার ভূকম্পণ রেকর্ড করা হয়। এরপর ঐ এলাকায় আরো ৩টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। আমরা যা দেখছি তা হলো উত্তর কোরিয়ার ভূমিতে একটা পরিবর্তণ লক্ষ্য করছি।’’
একটি পারমানবিক অস্ত্রের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণে এত বড় মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হলো। ৬টি পারমানবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের উত্তর কোরিয়ার ৭২০০ ফুট উচ্চতার বিশাল ম্যানটাপ পাহাড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এ ধরণের আরো বিস্ফোরণের এ পাহাড়টি ধ্বসে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। কি দানবীয় শক্তি ছিলো বিস্ফোরক ছয়টির। পারমানবিক অস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতা যে কত ভয়াবহ তা অনুমান করা অত্যন্ত কঠিন।
পারমাণবিক অস্ত্র ( Nuclear weapon ) এমন এক ধরনের যন্ত্র যা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে প্রাপ্ত প্রচন্ড শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করে। সে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ফিসানের (fission) ফলে অথবা ফিসান ও ফিউশান (fission and fusion) উভয়েরই সংমিশ্রনেও সংঘটিত হতে পারে। উভয় বিক্রিয়ার কারণেই খুবই অল্প পরিমাণ পদার্থ থেকে বিশাল পরিমাণে শক্তি নির্গত হয়। ফিসান আধুনিক এক হাজার কিলোগ্রামের একটি থার্মো-নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বিস্ফোরন ক্ষমতা প্রচলিত প্রায় ১ বিলিয়ন কিলোগ্রামের প্রচন্ড বিস্ফোরক দ্রব্যের চেয়েও বেশি। এভাবেই শুধুমাত্র প্রচলিত বোমার সমান আকারেই একটি পারমাণবিক বোমা দ্বারাই একটি শহরকে ধ্বংস করে দেয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে দু’টি আনবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় আমেরিকা। যুদ্ধের ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাত্র দুটি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। লিটল বয় নামের প্রথম বোমাটি ৬ আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমাতে এবং ফ্যাট ম্যান নামক দ্বিতীয় বোমাটি তিনদিন পর জাপানের নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করা হয়। ২৮ ইঞ্চি ব্যাসার্ধ, ১০ ফুট দৈর্ঘ আর ৯,৭০০ পাউন্ড ওজনের লিটল বয়- এর মধ্যে ইউরিনিয়াম জ্বালানী ছিল মাত্র ১৪০ পাউন্ড। লিটল বয়- এর বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ১৫,০০ টন টিএনটি সমতুল্য। আর ৬০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধ, ১০ ফুট ৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ আর ১০,৮০০ পাউন্ড ওজনের ফ্যাট ম্যান- এর মধ্যে প্লুটোনিয়াম জ্বালানী ছিল মাত্র ১৩.৬ পাউন্ড। লিটল বয়- এর বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ২১,০০০ টন টিএনটি সমতুল্য। এ বিস্ফোরণ দু’টির ফলাফল ছিল ভয়াবহ। প্রচন্ড বিস্ফোরণ ও ক্ষতিকর আলোক-কণা বিকিরণের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে মারা গিয়েছিল প্রায় ১,২০,০০০ মানুষ এবং আয়নাইজিংয়ের ফলে ধীরে ধীরে আরো অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছিল।
হিরোশিমা ও নাগাসাকির সেই বিস্ফোরনের পরেও এখন পর্যন্ত আরও পাঁচ শতাধিকবার পরীক্ষামূলকভাবে এবং প্রদর্শনের জন্য এ বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। বর্তমানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরন ঘটিয়েছে এবং মজুদ রয়েছে এমন দেশগুলো হল - যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত ও পাকিস্তান। এছাড়া এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে - উত্তর কোরিয়া, ইসরাইলেও পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে বর্তমানে ১৬,৩০০টি আণবিক বোমা আছে।এর মধ্যে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দখলেই রয়েছে প্রায় ১৪,০০০ পারমানবিক অস্ত্র।
রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশি: স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইন্সটিটিউট সিপ্রি((SIPRI)-র তথ্য অনুসারে রাশিয়ার কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আনবিক বোমা রয়েছে। দেশটিতে এ ধরনের বোমার সংখ্যা সাড়ে সাত হাজার। ১৯৪৯ সালে সেদেশ প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা করেছিল।
দ্বিতীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে এবং একমাত্র দেশ যারা এটা যুদ্ধে ব্যবহারও করেছে। দেশটির এখন ৭,০০০ টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
ফ্রান্সের সাবমেরিনে পারমাণবিক বোমা: ফ্রান্সের কাছে পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে তিনশ’র মতো। এগুলোর অধিকাংশই রয়েছে সাবমেরিনে। দেশটির অন্তত: একটি সাবমেরিন সবসময় পারমাণবিক বোমা নিয়ে টহল দেয়।
চীনও পিছিয়ে নেই: ২৭০টি পারমাণবিক বোমা আছে চীনের। রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সংখ্যাটা কম হলেও দেশটি ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়াচ্ছে। স্থল, আকাশ বা সমুদ্রপথে এসব বোমা ছোঁড়া সম্ভব।
যুক্তরাজ্যেরও আছে পারমাণবিক বোমা: ২১৫টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে যুক্তরাজ্যের কাছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এই দেশটি ১৯৫২ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়।
দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে পাকিস্তান: ইতোমধ্যে তিনবার প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে পাকিন্তান। দেশটির আছে ১৩০ থেকে ১৪০টি আণবিক বোমা৷ সা¤প্রতিক সময়ে পারমাণবিক বোমার সংখ্যা বাড়িয়েছে দেশটি। অনেকে আশঙ্কা করেন, প্রতিবেশীর সঙ্গে দেশটির লড়াই কোন এক সময় পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
থেমে নেই ভারত: ভারত প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় ১৯৭৪ সালে। দেশটির কাছে আণবিক বোমার সংখ্যা ১২০ থেকে ১৩০টি। ভারত অবশ্য জানিয়েছে, তারা আগে কোনো দেশকে আঘাত করবে না, আর যেসব দেশের পারমাণবিক বোমা নেই, সেসব দেশের বিরুদ্ধে তারা এ ধরনের বোমা ব্যবহার করবে না কোনোদিন।
ইসরায়েল সম্পর্কে তথ্য কম: ইসরায়েল অবশ্য নিজের দেশের পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে তেমন কিছু জনসমক্ষে প্রকাশ করে না। দেশটির আশিটির মতো পারমাণবিক ‘ওয়ারহেড’ আছে বলে ধারণা করা হয়।
উত্তর কোরিয়া: এখন পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার কাছে ১০ থেকে ২০টির মতো পারমাণবিক বোমা রয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্ম কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের (ACA) তথ্য অনুসারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বর্তমানে যে পরমাণু অস্ত্র মজুদ রয়েছে তার বেশির ভাগ দু’টি দেশের হাতে রয়েছে। বিশ্বের ৯৩ শতাংশ পারমাণবিক অস্ত্র এই দুই দেশের হাতে রয়েছে। এ দেশ দু’টি হলো যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এর মধ্যে ১০ হাজার অস্ত্র সেনাবাহিনীর কাছে কার্যোপযোগী অবস্থায় আছে।
পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার চেষ্টার কারণে ২০১৭ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায় ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস- আইসিএএন(ICAN) । বিশ্বের ১০১টি দেশের ৪৬৮টি বেসরকারি সংগঠনের আন্তর্জাতিক মোর্চা আইসিএএন যাত্রা শুরু করে ২০০৭ সালে। এই জোটের সদরদপ্তর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়।
নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বেরিত রাইস আন্দারসেন ঐসময় নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করে বলেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার যে বিশ্বে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে, সে বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করার পাশাপাশি এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় আইসিএএন-কে নোবেল দেওয়া হচ্ছে।
আইসিএএন-এর চেষ্টা ও চাপে জাতিসংঘের ১২২টি সদস্য দেশ পরমাণু অস্ত্র নিরোধ চুক্তির পক্ষে সমর্থন দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়াসহ পারমাণবিক অস্ত্রধারী হিসেবে পরিচিত নয়টি দেশ তাতে সাড়া দেয়নি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস (আইসিএএন)-এর দেয়া তথ্যানুসারে, আরো প্রায় ৪০টি দেশ ক্রমাগত পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলো এখনো নতুন নতুন পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে এবং অন্য যেসব রাষ্ট্র এই বোমা বানানোর চেষ্টা করছে তাদের নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
কিন্তু মানবিকতা বিবর্জিত রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি আর টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে কত দিন এভাবে এই পৃথিবীকে ১৬ হাজার পরমাণু বোমার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
টেলিগ্রাফের একটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্মিলিতভাবে যে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে তার ধ্বংস ক্ষমতা ছয় হাজার ৬০০ মেগাটন এরও বেশী। সারা বিশ্ব প্রতি মিনিটে যে পরিমাণ সৌরশক্তি গ্রহণ করে তার ১০ ভাগের এক ভাগ রয়েছে ওই পারমাণবিক অস্ত্রের। নিউকম্যাপ ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, মার্কিন অস্ত্রাগারে সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন বৃহৎ যে বোমা তার নাম বি-৮৩। এটি প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ১৪ লাখ লোক হত্যার ক্ষমতা রাখে। এ ছাড়া তাপ বিকিরণে আহত হবে ৩৭ লাখ মানুষ। এই বোমার বিকিরণ ছড়াবে ১৩ কিলোমিটার ব্যাসার্ধজুড়ে। অনুরূপভাবে রাশিয়ার সর্ববৃহৎ টাসার বোমা যেটি ইউএসএসআর নামে পরিচিতি। এটি নিউ ইয়র্কে আঘাত হানতে সক্ষম। ধারণা করা হয় এটি ৭৬ লাখ মানুষ হত্যা করতে পারে এবং ৪২ লাখেরও বেশি মানুষকে আহত করতে সক্ষম। এটি বিকিরণ ছড়াবে প্রায় সাত হাজার ৮৮০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে; যার প্রভাব পড়বে কোটি কোটি মানুষের ওপর।
ধ্বংসের আশংকায় কম্পমান পৃথিবীকে, পৃথিবীর সকল প্রাণী ও বনি আদমকে বাঁচাতে হলে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। বিশেষকরে পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ধ করতে হবে। পারমানবিক শক্তিধর সকল দেশেকে পরমাণু অস্ত্র নিরোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করতে হবে পরিমানিক অস্ত্রের সকল মজুদ। গড়ে তুলতে হবে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব ।
লেখক- শিক্ষক, সংগঠক, muaj1975@gmail.com