এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর, ২০২৪, ০৪:১০ পিএম
অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপক সমর্থন ও জনপ্রিয়তা রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার।
তিনি বলেছেন, সব প্রক্রিয়া শেষে গণতান্ত্রিক নির্বাচন দিতে হবে, যার মাধ্যমে নতুন সংসদ এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠিত হবে। এর ফলে মৌলিক অধিকারের প্রতি 'আইনের শাসন ও শ্রদ্ধার' প্রতি মানুষ সতেচন থাকবে।
‘আকাশছোঁয়া’ উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেও পরিবর্তন সবসময়ই ‘কঠিন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এগুলো হচ্ছে এমন নীতি যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের মূল বিষয়।’
বাংলাদেশ-ইইউ অংশীদারত্বকে দ্রুত বিকাশমান ও গতিশীল হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত বছর দুই পক্ষের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জনপ্রিয়তা খুবই স্পষ্ট। দলমতের ঊর্ধ্বে সবার সমর্থন পাওয়া প্রকৃতপক্ষে খুবই শক্তিশালী।
তিনি বলেন, এটি কঠিন সময়। সবকিছু বা সব ধরনের সংস্কার-একসঙ্গে করা সম্ভব নয়, তবে কিছু সফলতা দ্রুত অর্জন করতে হবে।
মিলার বলেন, সরকার যে সংস্কার করতে সক্ষম, তাদের সেটি প্রমাণ করে দেখাতে হবে। ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশছোঁয়া। রাজপথের চাপ অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এখানে দ্রুত কিছু সফলতা অর্জন করতে হবে যা এখনও গঠনমূলক।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি প্রক্রিয়া থাকতে হবে। আমরা মনে করি, সেই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে কিছু সময় দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; যাতে তারা প্রমাণ করতে পারে, এসব সংস্কার করতে তারা সক্ষম।’
এসব বাস্তবায়ন অত্যন্ত জটিল বলে উল্লেখ করেন মিলার। একই সঙ্গে উপদেষ্টাদের উদ্দেশে মিলার বলেন, তাদের সম্পদের অভাব নেই।
তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব নেই। আপনাদের অগ্রাধিকারগুলো কী, তা দয়া করে আমাদের বলুন এবং তারপরে আপনার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ দেন আমাদের। আমরা অনেক কিছু করতে পারি।’
অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন দেশের পরিবর্তন ও প্রত্যাশিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে সরকারকে সহযোগিতা করতে উৎসাহী রাষ্ট্রদূত মিলার। উভয়ের কাছে সুশাসন, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারে প্রতি শ্রদ্ধা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে নতুন অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি (পিসিএ) নিয়ে প্রথম দফার আলোচনা আগস্টে স্থগিত করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে নতুন চুক্তির জন্য তাদের কাছে একটি লিখিত বার্তা রয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে সেটি বাংলাদেশি পক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি (পিসিএ) নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আলোচনা অব্যাহত থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সুরক্ষাসহ বিস্তৃত নীতিগত ক্ষেত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাদের সম্পর্ককে উন্নত করাই পিসিএর ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য।
মিলার বলেন, ‘আমরা এখন ব্রাসেলস থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের মিশন প্রস্তুত করছি। তারা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় আসবেন এবং যেখানে আমরা কেবল এই নতুন পিসিএ নিয়েই আলোচনা করব না, বরং চুক্তির অগ্রগতি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যৌথ কমিশন নিয়েও আলোচনা করব।’
তিনি বলেন, শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা রয়েছে এবং রাজনৈতিক বার্তার বাইরেও তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের চাওয়া অনুযায়ী পরিবর্তনগুলো সাচ্ছন্দ্যে করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা চেয়েছিলাম সর্বত্র সুশাসন চালু করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকুক। অবশ্যই, এটি আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার সময়, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের বিষয়ে তাদের কাছে বলার মতো ভালো বিষয় রয়েছে। তিনি যখন তিন বা চার বছর পরে চলে যাবেন, তখন তিনি চাইবেন এই অংশীদারিত্ব রাজনৈতিক ও অধিকারভিত্তিক হোক, পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও উন্নয়নভিত্তিক হোক। তাদের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও বিস্তৃত ও গভীর করার সুযোগ রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা ভালো।
তিনি বলেন, ‘তবে একসঙ্গে আরও কিছু করার সুযোগ রাজনৈতিক মৌলিক রূপে হতে চলেছে, যা আপনারা শুরু করেছেন এবং যেখানে আমরা সম্ভবত সাহায্য করতে পারব।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, যদি তারা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে পারে এবং এটি বাণিজ্যিক সম্পর্কের সঙ্গে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবে তিনি এটিকে ভালো ফলাফল বলে মনে করবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা এটি মাথায় রেখে অংশীদারিত্বের জন্য সবেমাত্র ইউরোপীয় চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠা করেছি। তাহলে এতে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থা সম্পর্কে একমত হওয়ার বিষয়ও রয়েছে। আমি কল্পনা করতে পারি না, বাংলাদেশ আমাদের থেকে কোথাও ভিন্ন। আমাদের সিদ্ধান্তগুলোকে সাধারণ স্বার্থ এবং দুই পক্ষকে সম্পৃক্ত করতে ব্যবহার করতে হবে।’
ইইউ বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। কারণ দেশটি তৈরি পোশাকের পাওয়ার হাউস এবং ইইউ বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। এটি দেশটির জনগণের পরিশ্রমী মনোভাব প্রদর্শন এবং বিশ্বব্যাপী এর পণ্যগুলোর জন্য চাহিদা তৈরি করছে।
ইইউ বলছে, বাংলাদেশের সাফল্যের গল্পের পরবর্তী অধ্যায় লেখা হবে। কারণ তারা দেশটির অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে সহায়তা করবে।
এর জন্য, ইইউ নিরাপদ, উন্মুক্ত ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ হিসেবে ইইউর গ্লোবাল গেটওয়ে উদ্যোগের মাধ্যমে অবকাঠামো, সংযোগ, ডিজিটালাইজেশন ও বেসরকারি খাতে বৃহত্তর বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে।
একই সঙ্গে, তারা নতুন ইউরোপীয় চেম্বার অব কমার্সের মাধ্যমে আমাদের ব্যবসায়িক প্রচারকে শক্তিশালী করছে এবং অবশ্যই সঠিক কর্মপদ্ধতি ও শ্রম খাত সংস্কারে সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তারা মূলত তিনটি কাজ করতে চান। প্রথমটি হলো সরকারকে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অসুবিধাগুলো মোকাবিলায় সহায়তা করা।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘তাহলে, এটি ৩৯টি স্টপ শপ নয়, বরং ওয়ান স্টপ শপ হতে হবে। এটি খুবই সোজাসাপটা। আমাদের নিজেদের অর্থনৈতিক অপারেটরদের বিনিয়োগে রাজি করানোর পরিবর্তে, এর মাধ্যমে ব্যবসা সহজতর করে, আমরা এটি আরও সহজে করতে পারব।
তিনি বলেন, বাণিজ্যিক সম্পর্ক ‘বিস্তৃত’ এবং সত্যিই ‘চিত্তাকর্ষক” হলেও, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের সম্পর্ক তেমন নয় এবং তা তাদের সঙ্গে মেলে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় বাজারে প্রতিযোগিতা করা অন্যান্য অঞ্চলের কিছু দেশের তুলনায়, এফডিআই স্টক ১০ গুণ কম। এ বিষয়ে তাদের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়টি, অর্থনৈতিক সম্পর্কের অগ্রাধিকার হিসেবে, বাধা অপসারণের উপায় খুঁজে বের করা হবে। মিলার বলেন, ‘এটি বন্দর থেকে বাজারে জ্বালানি সরবরাহ, কাস্টমস ও পরিবহন-সবক্ষেত্রে আমরা খুব সক্রিয় এবং এখানে ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকও সক্রিয়।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ব্যবসা সহজীকরণ, বাধাগুলো অপসারণ করা এবং এরপর জিএসপি প্লাসে স্থানান্তর নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, তৈরি পোশাক খাত সত্যিই অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং অত্যাধুনিক কারখানাও রয়েছে এ খাতে। অবশ্যই, তিনি যেসব কারখানা পরিদর্শন করেছেন সেগুলো আকর্ষণীয়।
মিলার বলেন, ‘এ খাতের সর্বত্রই উন্নয়নের প্রয়োজন হবে। আপনাদের অবশ্যই বিপুল সক্ষমতা রয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন-আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এটি অত্যন্ত বাধাবিপত্তিহীন পরিবর্তন, তৈরি পোশাক খাতে কর্মস্থলের নিরাপত্তার মান উন্নত করতে হবে; যা মূলত সার্কুলার ইকোনমি হিসেবে ব্যবসার মডেলকে গ্রহণ করে।’
তিনি বলেন, দেশটি সব শ্রম বাজারের মান এবং পরিবেশগত মান বাস্তবায়ন করছে, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মিলার বলেন, ‘দেশটি যাতে চমৎকার গুণগত মানসম্পন্ন ব্যবসার মডেলের দিকে অগ্রসর হতে, পারে তা নিশ্চিত করতে, আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করব। কিন্তু তৈরি পোশাক নয়, এমন কিছুতে বিনিয়োগ করতে হবে; যাতে আরও মূল্য সংযোজিত হয়।’
বহমুখীকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, কোন খাতগুলোতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, তা তাদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে খুঁজে বের করতে হবে। ‘সেক্ষেত্রে, আমি মনে করি এটি চামড়া। এছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংও হতে পারে।’
তিনি বৈচিত্র্যতার বিষয়ে কথা বলেছেন, কারণ বর্তমানে বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব সংকীর্ণভাবে কেন্দ্রীভূত এবং তাদের বিবেচনায় জিএসপি প্লাস পদ্ধতি থাকায় বাংলাদেশকে অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত নয়।
তিনি আরও বলেন, ‘সুতরাং অত্যন্ত গতিশীল এই দেশের অন্যান্য খাতে প্রতিযোগী হওয়ার বিষয়টি পরিকল্পনা করার সময় এসেছে। একইভাবে ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের প্রস্তুতিরও। আমি মনে করি এটি আপনাদের এবং স্পষ্টভাবে আমাদেরও স্বার্থ।’
বাংলাদেশি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে, রাষ্ট্রদূত বলেন এটি সম্মিলিত দায়িত্ব। মিলার বলেন, ইউরোপীয় ভোক্তারা তাদের পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির খ্যাতির প্রতি যত্নশীল।
ইইউ জানিয়েছে, মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের রেকর্ড শক্তিশালী, বিশেষ করে যুবকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে। বাংলাদেশ ইইউ এরাসমাস+ স্কলারশিপের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। দেশটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও উল্লেখযোগ্য সমর্থন পায়।
রাষ্ট্রদূত বলেন, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে খুবই আগ্রহী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে একসঙ্গে আরও কাজ করতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে যা ঘটছে তা ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, এটি আমাদের ঘনিষ্ঠ অংশীদারসহ সব অংশীদারের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্কের উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
বিস্তৃত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, ইইউ ও বাংলাদেশ অনেক বছর ধরে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জে মোকাবিলায় বহুপাক্ষিক সমাধানে একসঙ্গে কাজ করে আসছে।