ঢাকা, বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৪, ২০২৪ | ৩০ কার্তিক ১৪৩১
Logo
logo

ট্রাম্পের বিজয়ে খুশি সৌদি আরব, সতর্ক কাতার


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ০৬:১১ পিএম

ট্রাম্পের বিজয়ে খুশি সৌদি আরব, সতর্ক কাতার


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো। এই অঞ্চলের প্রতিটি রাষ্ট্রই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় আসার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ভাবছে।

পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) ছয় সদস্য দেশ ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানাতে কালক্ষেপণ করেনি। তবে সবার আগে জানিয়েছেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ফলাফল ঘোষণার প্রথম দিকেই টেলিফোনে ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এই আরব নেতা। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ্যে আসে সাংবাদিক খাশোগি হত্যাকাণ্ড সময়। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা ও বিচারের দাবি উঠলে সৌদি যুবরাজের পাশে ছিলেন ট্রাম্প। তাই ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদকে নিজের অনুকূলেই দেখছে রিয়াদ।

মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপসাগরীয় দেশগুলো ট্রাম্পের প্রতি প্রকাশ্যে পক্ষপাতী নয়। তাঁরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে চায়।

ব্রিটিশ থিংকট্যাংক চাটহ্যাম হাউসের গবেষক ও কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক বদর আল-সাইফ বলেন, জিসিসি দেশগুলো এখন শিখেছে যে, তাঁদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুপার পাওয়ারের ভারসাম্য বজায় রেখে দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বের জন্য চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কও শক্তিশালী করেছে এসব দেশ।

ইরানের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক মিত্রতা মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলো প্রমাণ করেছে, তাঁরা ইরানের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী ও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ট্রাম্পের আগের মেয়াদের ইরানবিরোধী নীতি উপসাগরীয় দেশগুলোর বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার খাতিরে নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করবে উপসাগরীয় দেশগুলো।

উপসাগরীয় দেশ বিষয়ে ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক আন্না জ্যাকবস বলেন, ‘ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের নীতিমালা সৌদি-আরব আমিরাতের আঞ্চলিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ইরানের ওপর সর্বাধিক চাপ প্রয়োগ ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐক্যমত ছিল। তবে এখন জিসিসি ইরানের সঙ্গে এক শীতল সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এমন একটি সম্পর্ক—যেখানে তারা আলোচনা করতে পারে ও প্রয়োজনে উত্তেজনা কমাতে পারে। আমি মনে করি, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই, বিশেষত রিয়াদ, ইরানের সঙ্গে এই সম্পর্ক বজায় রাখাকে অত্যন্ত উপকারী মনে করে।’

ফিলিস্তিন সংকট

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির শেষদিকে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ ঘটে। তবে গাজা সংকটে উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরায়েলের কঠোর সমালোচনা করেছে, যেখানে সৌদি আরব এটিকে প্রকাশ্যে গণহত্যা আখ্যা দিয়েছে। সাম্প্রতিক গাজা পরিস্থিতি এবং ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন রক্ষায় উপসাগরীয় দেশগুলো একজোট হয়েছে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাঁদের অবস্থান অটল ও এই ইস্যুতে তাঁরা ট্রাম্পের ভূমিকা দেখতে চায়।

আব্রাহম অ্যাকর্ড নিয়ে বই লেখক ও গবেষক এলহাম ফাখরো বলেন, ‘সমস্ত উপসাগরীয় দেশই একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র দেখতে চায়। এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী দেশগুলোও একই অবস্থান নিয়েছে।’

ফাখরো আরও বলেন, বাইডেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গাজায় হত্যাযজ্ঞ চালাতে পুরোপুরি রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন দিয়েছেন। তিনি যুদ্ধবিরতির জন্য কোনো অর্থপূর্ণ চাপ প্রয়োগেও ব্যর্থ হয়েছেন। অপরদিকে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নেতানিয়াহুকে ‘কাজ শেষ করতে’ দেবেন—যা বাইডেনের নীতিরই ধারাবাহিকতা। এখন উপসাগরীয় নেতারা ট্রাম্পকে তাঁদের অবস্থান বুঝানোর চেষ্টা করবেন।’

নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তবে জ্যাকবস বলছেন, খামখেয়ালী প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প সবসময়ই যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। ফলে ট্রাম্প হয়তো যুদ্ধ শেষ করতে চান, তবে তিনি ইসরায়েলের স্বার্থের দিকে নজর রেখেই সেটি করবেন। ফলে বিষয়টি আরও জটিল হতে পারে।

কাতারের অবস্থান ও উদ্বেগ

তবে উপসাগরীয় দেশগুলোর থেকে প্রায়শই আলাদা অবস্থানে থাকে কাতার। কাতারের পররাষ্ট্রনীতি উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বপূর্ণ হয়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৭ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় দেশগুলো কাতারের ওপর অবরোধ দিয়েছিল, যদিও পরে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তাই ট্রাম্পের আবার ক্ষমতায় আসায় কাতার কিছুটা উদ্বিগ্ন।

গাজা বিষয়ে কাতারের ভূমিকা বিশেষভাবে স্পর্শকাতর, কারণ হামাসের অনেক নেতাই কাতারে অবস্থান করেন। গাজা ইস্যু ও দোহার সঙ্গে হামাসের সম্পর্কের কারণে ট্রাম্প প্রশাসন দেশটির ওপর কী ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে— সেই বিষয়টি কাতার সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবে। বিশ্বমঞ্চে ট্রাম্প খামখেয়ালী হওয়া সত্ত্বেও উপসাগরীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি এমন সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী—যা তাঁদের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হবে।