এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ১৫ মার্চ, ২০২৫, ০৫:০৩ পিএম
কাজী তরিকুল ইসলাম। দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানে সফল কর্মজীবন কাটানো এই যুবক তিন বছর আগে স্বপ্ন দেখেছিলেন পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোর। মনোমুগ্ধকর বিজ্ঞাপন দেখে তিনি যোগাযোগ করেন ‘ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেড’ নামের একটি এজেন্সির সঙ্গে। এই এজেন্সি বিভিন্ন দেশে ভিসা প্রসেসিং এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে লোক পাঠানোর কাজ করে বলে দাবি করে। তরিকুল ইসলামের স্বপ্ন ছিল যুক্তরাজ্যে গিয়ে একটি ভালো চাকরি পেয়ে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করা। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন ধূলিসাৎ। ফেইথ ওভারসিজের প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে তিনি এখন হতাশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
তরিকুল ইসলাম ফেইথ ওভারসিজকে মোট ২৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দেন কিস্তিতে। এজেন্সিটি টাকা নেয় তিনটি ভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। চুক্তি অনুযায়ী, টাকার লেনদেন শেষ হওয়ার পর তরিকুল ইসলাম পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পরই শুরু হয় তার দুর্ভোগ। ফেইথ ওভারসিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই চাকরি তিনি পাননি। বরং দুই বছর ধরে তাকে বিভিন্ন অজুহাতে ঘুরপাক খাওয়ানো হচ্ছে। এখন তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চরম হতাশায় ভুগছেন। তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। স্পন্সরশিপ এবং চাকরি না পেলে যে কোনো সময় তাকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গ্রেপ্তার হতে পারে অথবা দেশে ফিরে আসতে হতে পারে।
তরিকুল ইসলামের মতো আরও অনেকেই ফেইথ ওভারসিজের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। যুক্তরাজ্য, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে চাকরি এবং স্টুডেন্ট ভিসার নামে এই এজেন্সি লোক পাঠানোর দাবি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না। তরিকুল ইসলামের অভিজ্ঞতা শুনলে যে কারও মন কেঁদে উঠবে।
তরিকুল ইসলাম খুলনার সোনাডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা। তিনি ফেইথ ওভারসিজের খুলনা শাখার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। ফেইথ ওভারসিজের খুলনা শাখার ইনচার্জ জর্জ মিথুন রায় তরিকুলকে আশ্বস্ত করেন যে, তারা বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে এবং জব ভিসার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। জর্জ মিথুন রায়ের কথায় আস্থা রেখে তরিকুল ইসলাম কয়েক দফায় মোট ২৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দেন। ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট তিনি যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডে পৌঁছান। এক মাস পর স্ত্রী এবং কন্যাকে সেখানে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পরই শুরু হয় তার দুর্ভোগ।
ফেইথ ওভারসিজ তরিকুল ইসলামকে যুক্তরাজ্যের ওয়েসিস প্রাইভেট কেয়ার লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে চাকরির পরিবর্তে প্রশিক্ষণের নামে সময় কাটাতে হয়। একটার পর একটা প্রশিক্ষণ শেষ করতে করতে ছয় মাস কেটে যায়। কিন্তু চাকরির কোনো সন্ধান মেলে না। এর মধ্যে তরিকুল ইসলাম জানতে পারেন যে, ওয়েসিস প্রাইভেট কেয়ার লিমিটেডের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ, যে প্রতিষ্ঠানে তাকে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানই এখন বেআইনি। এই খবর তরিকুল ইসলামকে চরম হতাশায় ফেলে দেয়।
এখন তরিকুল ইসলাম এবং তার পরিবার যুক্তরাজ্যে অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। তাদের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। ধারদেনায় ডুবে গেছেন তিনি। দেশে ফিরে আসারও কোনো উপায় নেই। ফেইথ ওভারসিজের প্রতারণার ফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে এখন তিনি আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে তরিকুল ইসলাম ছাড়াও আরও অনেকেই প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। আহসান হোসেন, রুবাইয়া হক, সাদিয়া ইসলাম এবং লিপি বেগমের মতো অনেকেই ফেইথ ওভারসিজের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে গিয়েছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা চাকরি পাননি। বরং অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। আহসান হোসেন বলেন, ফেইথ ওভারসিজ তাকে চাকরির গ্যারান্টি দিয়ে যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি কোনো চাকরি পাননি। এখন তিনি ‘ক্যাশ ইন হ্যান্ডে’ কাজ করে কোনোরকমে জীবন চালাচ্ছেন।
রুবাইয়া হক আরও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, ফেইথ ওভারসিজ তাকে যুক্তরাজ্যের একটি ভুয়া কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পাঠায়। সেখানে গিয়ে তাকে চার মাস ট্রেনিংয়ের নামে বসিয়ে রাখা হয়। এরপর আট মাস কাজ করানো হয়, কিন্তু কোনো বেতন দেওয়া হয়নি। এখন তিনি ইউকে হোম অফিসে অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু তার সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।
অবশ্য ফেইথ ওভারসিজ কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা প্রতারণা করছে না। তবে নানা কারণে অনেককেই বিদেশে পাঠানো যাচ্ছে না বা বিদেশে পাঠানোর পর সেখানে চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানে তাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
খুলনা শাখা অফিস ইনচার্জ এবং ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেডের পরিচালক (এডমিন) জর্জ মিথুন রায় গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা তরিকুল ইসলামকে ইউকেতে (যুক্তরাজ্যে) পাঠিয়েছি। সেখানে স্পন্সরশিপ এবং জব গ্যারান্টির চুক্তি ছিল। সে অনুযায়ী তিনি ইউকেতেও যান। কিন্তু সেখানকার কোম্পানির নিয়ম-নীতি অনুযায়ী তিনি সব শর্ত পূরণ করতে না পারায় চাকরি হয়নি।”
তরিকুল ইসলাম কী কী নিয়ম-নীতি মানেননি, জানতে চাইলে উদাহরণ হিসেবে জর্জ মিথুন রায় বলেন, তাকে (তরিকুল) কোম্পানি থেকে দূরে অন্য শহরে যোগদানের কথা বলা হয় এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি তা করেননি।
তরিকুল ইসলাম বলছেন, “আমাকে ইংল্যান্ডের ভেতরে চাকরি দেওয়ার কথা, ওয়েসিস কেয়ার নামে কোম্পানির অবস্থান অক্সফোর্ডে। সেই কোম্পানির লাইসেন্সও বাতিল হয়েছে। তারা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।”
ওয়েসিসের বিষয়ে জর্জ মিথুন রায় বলছেন, যুক্তরাজ্যের ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার বিষয়ে তার জানা নেই।
তবে ইউকেতে যাওয়ার পর তরিকুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে যোগদান করতে না পারার বিষয়টি একাধিকবার তাকে জানিয়েছেন বলে স্বীকার করেন জর্জ মিথুন রায়।
জর্জ মিথুন রায় বলছেন, তরিকুল ইসলামের চাকরির জন্য তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কোম্পানিতে আবেদন করা হচ্ছে, চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
কোম্পানির নিজস্ব ব্যাংক হিসাবের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন একাউন্টে অর্থ গ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করে জর্জ মিথুন রায় বলেন, ভিশন এবং রং তুলি- এই দুটি ব্যাংক হিসাবও তাদের গ্রুপের।
ফেইথ ওভারসিজের পরিচালক (মার্কেটিং) পরিচয় দিয়ে কামরুল হাসান নামের আরেকজন বলেন, “তরিকুল ইসলামকে আমরা ইউকেতে পাঠিয়েছেন, এটাই তো বাস্তবতা। তো বাংলাদেশে বসে সেখানে চাকরির নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া সম্ভব? সব দায়িত্ব আমাদের না, তারও কিছু দায়িত্ব আছে।”
এই কামরুল ইসলামের পাল্টা অভিযোগ, তরিকুল ইসলাম ইউকেতে দুই বছর ধরে অবস্থান করছেন। কিন্তু ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের পর থেকেই তিনি বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি নানাভাবে তাদের হুমকি দিচ্ছেন এবং হয়রানি করছেন। তবে তার চাকরির জন্য চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”
কামরুল ইসলামের অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা দাবি করে তরিকুল ইসলাম বলেছেন, “আমিই যেখানে বিপদগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী, আমি কীভাবে হুমকি দেব? ফেইথ ওভারসিজ আমার সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করায় আমি মূলত আমার প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার চেষ্টা করছি। ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের সঙ্গে মিশিয়ে তারাই আমার সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।”
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতারণার আশ্রয় নিলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফেইথ ওভারসিজের বিরুদ্ধে প্রতারণার প্রমাণ থাকলে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন।
ফেইথ ওভারসিজের প্রতারণার শিকার হয়ে তরিকুল ইসলাম এবং আরও অনেকেই এখন অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। তাদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তারা এখন শুধু একটি ন্যায়বিচার চান। ফেইথ ওভারসিজের মতো এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ হবে না। প্রবাসীদের স্বপ্নকে পুঁজি করে যারা প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এবিষয়ে রাইজিংবিডি.কম সহ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এনবিএস/এসএইচ/এএম
রাইজিংবিডি.কমের সংবাদটি পড়তে নিচে ক্লিক করুন।
ফেইথের ‘ফাঁদে’ ফতুর প্রবাসী চান পরিত্রাণ
...