মো. মনিরুজ্জামান মনির প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল, ২০২৫, ০৪:০৪ পিএম
বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নতুন কিছু রাজনৈতিক শক্তি একদিকে “গণতন্ত্র” ও “সংস্কার” এর কথা বলছে, আবার অন্যদিকে ইতিহাস, আদর্শ এবং রাষ্ট্রচিন্তার মৌলিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই দ্বন্দ্ব, এই দ্বিচারিতা কতটা রাজনৈতিক যুক্তিবোধ থেকে উৎসারিত, আর কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভ্রান্তি—সেটাই এখন প্রশ্ন।
সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এক বক্তব্যে জানিয়েছে, তারা সংবিধানে “রাষ্ট্রের মূলনীতি” সংরক্ষণের বিপক্ষে। তাদের মতে, এগুলো কেবল নির্দেশনামূলক; বাস্তবিক প্রয়োজনে এগুলোর প্রয়োজন নেই। প্রশ্ন হলো—এটি কি কেবল রাজনৈতিক অজ্ঞতা, নাকি গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত?
মূলনীতি মানেই রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়
১৯৭২ সালের সংবিধান রচনার সময় “গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ”—এই চারটি মূলনীতি এক অভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এগুলো ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা, জনগণের আত্মত্যাগের প্রতীক।
এই চারটি মূলনীতি—
* নাগরিকের সমতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করে
* ধর্মীয় সহনশীলতা ও বৈচিত্র্য রক্ষার মৌলিক ভিত্তি
* সামাজিক ন্যায্যতা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অনুষঙ্গ
* এবং রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস হিসেবে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে
এই মূলনীতি সংবিধানে না রাখার অর্থ কী? তাহলে কি আমরা বলবো, “ভোটাধিকার”, “আইনের শাসন”, কিংবা “বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও” শুধুই আলংকারিক?
সংবিধান ‘সংশোধন’ নয়, ‘রক্ষা’র বিষয়
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান শুধু একটি আইনগ্রন্থ নয়—এটি জাতির নৈতিক চুক্তি। আর এর মূলনীতিগুলো সেই চুক্তির দিকনির্দেশক। যে দল এই মূলনীতির প্রয়োজন অস্বীকার করে, তারা কীভাবে বলবে তারা জনগণের প্রতিনিধি?
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, তারা “নতুন প্রজন্মের দল”। কিন্তু নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কি ইতিহাস অস্বীকার করাই যথেষ্ট? ২০০৮ সালের শিক্ষানীতিতে, ২০১০ সালের শিশু আইন, বা ২০১১ সালের সংবিধান ষোড়শ সংশোধনী রায়—সব জায়গাতেই রাষ্ট্রের মূলনীতির গুরুত্ব স্পষ্টভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আজ যদি এনসিপি বলে “মূলনীতি দরকার নেই”, কাল তারা কি বলবে—“ভোট দরকার নেই, মানবাধিকার দরকার নেই”? এটাই কি রাজনৈতিক প্রগতিশীলতা?
মূলনীতি ছাড়া রাজনীতি মানে কি?
নিচে কিছু প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, যেগুলোর জবাব এনসিপিকে জনগণকে দিতে হবে—
* গণতন্ত্র ছাড়া তারা কীভাবে জনগণের শাসন নিশ্চিত করবে?
* সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে কীভাবে তারা দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়বে?
* ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়াই কীভাবে তারা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেবে?
* জাতীয়তাবাদ পরিহার করে কোন আন্তর্জাতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের কথা ভাবছে?
এই প্রশ্নগুলো কেবল প্রতীকী নয়, বাস্তব। কারণ আমাদের রাজনীতি আজ আন্তর্জাতিক নানা প্রভাব ও অর্থায়নের মাঝে দাঁড়িয়ে। অতএব যারা মূলনীতি সরিয়ে রাখতে চায়, তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে—সেটাও খোলাসা হওয়া দরকার।
রাজনীতি না রসিকতা?
এক সময়ের গণআন্দোলনের কর্মী বা শিক্ষাবিদ যখন নতুন রাজনৈতিক দলের হাল ধরেন, তখন আশা জাগে—সম্ভবত এখন একটা নৈতিক রাজনীতি গড়ে উঠবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নিয়ে তারা এমনভাবে প্রশ্ন তোলে, যেন এটা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতা!
আমরা কি ভুলে গেছি—
* সংবিধানের জন্য লাখো শহীদ প্রাণ দিয়েছেন?
* মুক্তিযুদ্ধের দর্শন এই চার মূলনীতির ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল?
* আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতা—সবই মূলনীতির ফসল?
এনসিপি কি সত্যিই বোঝে না, নাকি না বোঝার ভান করে?
নির্বাচনমুখী মতলব নয়, জনস্বার্থই মুখ্য হোক
বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্বাচনকে সামনে রেখে অবস্থান নিচ্ছে, তখন অনেকেই নানা “বিকল্প কথা” বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়। তারা চায়, জনগণ নীতিকে ভুলে ‘ব্যক্তি-পরিচয়’ আর ‘প্যাকেজড উন্নয়ন’ ঘিরে ভোট দিক।
কিন্তু জনগণের প্রশ্ন:
* যারা সংবিধানকেই অস্বীকার করে, তারা ক্ষমতায় গেলে কী রক্ষা করবে?
* তারা যদি রাষ্ট্রীয় আদর্শই সরিয়ে দিতে চায়, তাহলে গণতন্ত্র তাদের কাছে কী?
ভবিষ্যতের জন্য শপথ
সংবিধান কোনো ‘ম্যাজিক ধারা’ নয়, এটি একটি জীবন্ত দলিল। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি মূলনীতি জনগণের রক্তে লেখা। যারা এই রক্তের দামে কেনা দলিল নিয়ে ছেলেখেলা করতে চায়, তাদের উচিত রাজনীতির অঙ্গন থেকে বিদায় নেওয়া।
সত্যিকারের গণতন্ত্রের শর্ত হলো—আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার। তাই আজ সময় এসেছে, জনগণ এই প্রশ্ন তুলুক—
“কারা আদর্শ রক্ষা করছে, আর কারা বিক্রি করে দিচ্ছে?”
আজ যখন চারপাশে রাজনৈতিক হতাশা, বিশ্বাসহীনতা আর অস্থিরতা, তখন জনগণ আশাবাদী হয়ে তাকিয়ে আছে—নতুন কেউ আসবে, নতুন কিছু বলবে, কিন্তু সেটা যেন ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, সংবিধানের প্রতি দায়িত্ব নিয়ে হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-কে এখনই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে: তারা কি আদর্শগত রাজনীতি করবে, নাকি মুখরোচক বিতর্কের আড়ালে বিভ্রান্তির রাজনীতি?
একটি কথাই শেষ কথা—
“সংবিধান নিয়ে রাজনীতি নয়; সংবিধান রক্ষা করাই রাজনীতির আসল কাজ।”
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট