ঢাকা, সোমবার, ডিসেম্বর ৮, ২০২৫ | ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
Logo
logo

চীনের ‘ব্লু সোর্ড’ মহড়ায় সৌদি আরবের কৌশল বদল, যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে নতুন নিরাপত্তা জোট?


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ১৮ অক্টোবর, ২০২৫, ০৮:১০ পিএম

চীনের ‘ব্লু সোর্ড’ মহড়ায় সৌদি আরবের কৌশল বদল, যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে নতুন নিরাপত্তা জোট?

সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা খাতে এখন স্পষ্টভাবে চীনের প্রভাব বাড়ছে। দুই দেশ মিলে শুরু করেছে তৃতীয় যৌথ নৌ-মহড়া ‘ব্লু সোর্ড ২০২৫’, যা শুধু সামরিক সহযোগিতাই নয়, বরং রিয়াদের নিরাপত্তা স্বনির্ভরতার পথে বড় পদক্ষেপ।

রিয়াদের পূর্ব উপকূলে কিং আবদুল আজিজ নৌঘাঁটিতে শুরু হওয়া এই মহড়ায় অংশ নিয়েছে দুই দেশের নৌবাহিনী। সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, মহড়ার মূল লক্ষ্য হলো ‘অভিজ্ঞতা বিনিময় ও যুদ্ধ-প্রস্তুতি বৃদ্ধি’।

চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সিনিয়র কর্নেল জিয়াং বিন বলেছেন, এই মহড়া সেনাদের মধ্যে কৌশল বিনিময় ও সামরিক বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করবে।

‘ব্লু সোর্ড’ মহড়ার ইতিহাস

২০১৯ সালে প্রথম মহড়া হয় চীনের গুয়াংডং প্রদেশে, যেখানে সন্ত্রাসবিরোধী ও জলদস্যু দমন প্রশিক্ষণ হয়েছিল।
দ্বিতীয় মহড়া হয় ২০২৩ সালে ঝানজিয়াংয়ে, যেখানে বিশেষ অভিযান, উদ্ধার ও সমুদ্রবোর্ডিং অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এ বছর যুক্ত হয়েছে ট্যাকটিক্যাল ড্রোন ও সামুদ্রিক মাইন নিষ্ক্রিয়করণের অনুশীলন—যা আধুনিক যুদ্ধপ্রস্তুতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

রিয়াদ-বেইজিং সম্পর্কের সাম্প্রতিক উষ্ণতা

গত জুনে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান বেইজিং সফর করে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী দং জুন ও সামরিক কমিশনের উপ-চেয়ারম্যান ঝাং ইউসিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়।

এর আগে মে মাসে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীদের নেতৃত্বে বেইজিংয়ে নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক হয়। সৌদি উপমন্ত্রী আবদুলআজিজ বিন মুহাম্মদ বিন আয়াফ বলেন, “বন্ধুত্বপূর্ণ আস্থা ও পারস্পরিক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করেই এই নিরাপত্তা সহযোগিতা গড়ে উঠছে।”

প্রতিরক্ষা শিল্পেও চীনের অংশীদারিত্ব

গত মাসে সৌদি শিল্প ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী বান্দার আলখোরাইফ চীন সফরে তিনটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন—অ্যাভকো ইন্টারন্যাশনাল, লানশি সুপারঅ্যালয় ও বিএমজিকে’র সঙ্গে। এসব চুক্তি সৌদির মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা শিল্পে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমছে রিয়াদ

দোহায় গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলের হামলার পর সৌদি আরব বুঝতে পারে, মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা সবসময় কার্যকর নয়। ফলে রিয়াদ বিকল্প নিরাপত্তা সহযোগিতার পথ খুঁজছে।

এই ধারাবাহিকতায় ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরব স্বাক্ষর করেছে কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি, যেখানে বলা হয়েছে—“এক দেশের ওপর আক্রমণ মানে অপর দেশের ওপর আক্রমণ।”

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত নয়, বরং বহুমুখী নিরাপত্তা জালের অংশ। পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা রিয়াদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা আশ্বাস দিচ্ছে।

অস্ত্র বাণিজ্যে চীনের উত্থান

সিপ্রি’র (SIPRI) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চীন থেকে সৌদির অস্ত্র আমদানি ছিল ২৪৫ মিলিয়ন ডলার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
২০১৮–২০২২ সময়ে সৌদির ৭৮ শতাংশ অস্ত্রই এসেছে মার্কিন উৎস থেকে।

তবুও সৌদি আরব ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনায় লক্ষ্য স্থির করেছে—নিজস্ব সামরিক ব্যয়ের অন্তত ৫০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করবে। এজন্য রিয়াদ এমন অংশীদার খুঁজছে, যারা প্রযুক্তি, উপকরণ ও কারিগরি দক্ষতা সরবরাহ করতে পারবে—এক্ষেত্রে চীনকে উপযুক্ত মনে করছে তারা।

উপসংহার

২০২১ সালে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায়, চীনের সহায়তায় সৌদি আরব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। এটি দুই দেশের সহযোগিতার গভীরতা স্পষ্ট করে।

বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব এখনো যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে রাখছে, তবে চীনকে উপেক্ষা করছে না।
দোহা হামলার পর রিয়াদ বুঝেছে, একক নিরাপত্তা নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিস্থিতি চীনের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে সৌদি প্রতিরক্ষা কৌশলে প্রভাব বিস্তারের।

বেইজিং এখন রিয়াদের প্রতিরক্ষা উৎপাদন, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ অংশীদার, হয়তো প্রধান নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে অপরিহার্য কৌশলগত মিত্র হয়ে উঠছে।