ঢাকা, মঙ্গলবার, এপ্রিল ২২, ২০২৫ | ৮ বৈশাখ ১৪৩২
Logo
logo

কুস্তিগির মুলায়ম মরিয়া ছিলেন জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী করতে, অপূর্ণ থাকল নিজের ইচ্ছাও


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ১০ অক্টোবর, ২০২২, ০৩:১০ পিএম

কুস্তিগির মুলায়ম মরিয়া ছিলেন জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী করতে, অপূর্ণ থাকল নিজের ইচ্ছাও

কুস্তিগির মুলায়ম মরিয়া ছিলেন জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী করতে, অপূর্ণ থাকল নিজের ইচ্ছাও


সে দিন জ্যোতিবাবু ও মুলায়ম সিংহের (Mulayam Singh Yadav) যৌথ সভা এলাহাবাদের মাঠে। দ্বিতীয়জন তখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। সমাজবাদী পার্টি এবং সিপিএমের পতাকায় সেজেছে মঞ্চ, ময়দান। কলকাতা থেকে যাওয়া আমরা কয়েকজন সাংবাদিক সভাস্থলে পৌঁছে রীতিমতো চমকে উঠলাম। দেখি ভিড়ের মধ্যে হাতে হাতে সিপিএমের পতাকা উড়ছে। রহস্যটা কী?

জানলাম, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সর্বভারতীয় ইউনিয়নটি সিপিএমের দখলে। দায়িত্বে বাংলার নেতা রবিন দেব। তারাই এই ভিড়ের আয়োজক। আর একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম। শিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে জ্যোতিবাবুকে দেখা, ভাষণ শোনার আগ্রহ। ফলে ভিড় নেহাৎ মন্দ ছিল না।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হরকিষেন সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, সকলেই তখন বেঁচে। নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাঁদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন দুই যাদব নেতা উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম সিং (Mulayam Singh Yadav) এবং বিহারের লালু প্রসাদ। দেশে তখন তৃতীয় ফ্রন্ট অর্থাৎ কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধী ফ্রন্টের রাজনীতির রমরমা। মানুষের মধ্যে কৌতূহল তুঙ্গে। কংগ্রেসের ভ্রান্ত অর্থনীতি আর বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলির জোট।

বসু ও মুলায়ম (Mulayam Singh Yadav) যা বললেন, তাতে কলকাতার কাগজের জন্য খবরের অনেক রসদ পাওয়া গেল। সভা শেষে জ্যোতিবাবু মঞ্চ থেকে নামার সময় তাঁর কাছে যেতে হুড়োহুড়ি লেগে গেল স্থানীয় বাঙালিদের একাংশের মধ্যে। কেউ অটোগ্রাফ চান। কেউ পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চান। কেউ বাচ্চাকে কোলে তুলে দেখাচ্ছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে। প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে হাজির স্থানীয় সাংবাদিকেরাও। বিশৃঙ্খল অবস্থা। পুলিশ পেরে উঠছে না। আমরা কলকাতার সাংবাদিকেরাও সেই ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির শিকার। এসব পরিস্থিতিতে জ্যোতিবাবু প্রতিক্রিয়া সর্বদাই বিশুদ্ধ বাংলায়। ছায়াসঙ্গী আপ্ত সহায়ক জয়কৃষ্ণকে বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে! বসুর মুখ দেখে মুলায়ম মনে হয় বুঝলেন বসু কী বলেছেন।


জ্যোতিবাবুর সেই কথায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যেন মুহূর্তে পুলিশের কমান্ডো বনে গেলেন। অসুরের শক্তি নিয়ে সবাইকে ঠেলে দুরে সরিয়ে দিয়ে জ্যোতিবাবুকে গাড়িতে ওঠার পথ করে দিলেন তিনিই। তাঁর ঠেলা খেয়ে ছিটকে পড়ল অনেকে। মুলায়মের কনুইটা এসে লাগল আমার নাকে ও বুকে। দমবন্ধ হওয়ার জোগার। বয়স কম, কোনও রকমে সামলে নিলাম। জয়কৃষ্ণবাবু বলে গেলেন, কাল সকালে আপনারা গেস্ট হাউসে আসুন। জ্যোতিবাবু কথা বলবেন।’

মুলায়মের কনুইয়ের ধাক্কা খাওয়ায় এলাহাবাদের এক সাংবাদিক বন্ধু মজা করে বললেন, ‘ডাক্তার দেখিয়ে নিও। খাস কুস্তিগিরের ঘুষি।’ সেই সূত্রে জানতে পারলাম, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব একজন নামকরা কুস্তিগির ছিলেন একটা সময়। প্রচুর প্রতিযোগিতায় ভূপাতিত করেছেন প্রতিপক্ষকে। ঘুষির যন্ত্রণা অনেকদিন ছিল।

মুলায়মের রাজনীতির মধ্যেও কিন্তু ছিল সেই কুস্তিগিরের মেজাজ। কৈশোর, যৌবনে যা ছিল সখের খেলা, রাজনীতিতে সর্বদা সেই স্পিরিট নিয়েই চলেছেন। এমনকী ছেলের সঙ্গে লড়াই করতেও কুণ্ঠা করেননি। ২০১৭-র কথা। ভারতীয় রাজনীতিতে সেই প্রথমবার খাতায় কলমে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দলীয় পদ খোয়ালেন। তাও আবার নিজের ছেলের কাছে। অভাবনীয় সেই ঘটনায় বেশ কয়েকদিন দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের দফতরে বাপ-বেটা মুখোমুখি বসে দলের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। লখনউ থেকে এক বিমানে উঠেছেন। দিল্লির লখনউ নিবাসে উঠেছেন। তারপর কমিশনের অফিসে গিয়ে জামার আস্তিন গুটিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে দলের অধিকার নিয়ে তরজায় পেতেছেন।

তবে ভাগ্য সদয় হয়নি। কমিশনের বিচারে দলের দায়িত্ব পান ছেলে অখিলেশই। পরে বাবাকে দলের উপদেষ্টার পদে বসিয়ে অখিলেশ হয়ে যান সভাপতি এবং প্রধান কান্ডারি।

কুস্তিগিরের জেদ নিয়েই ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন সমাজবাদী শিবিরের দীর্ঘদিনের পাকা খেলোয়াড় মুলায়ম। তাঁকে মন্ত্রিসভায় নিতে ঘোর আপত্তি সনিয়া গান্ধীর। কিন্তু মুলায়মও নাছোড়। শেষ পর্যন্ত মুলায়মের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী।

১৯৯৬-এর লোকসভা ভোটের পর জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গড়তে কুস্তিগিরের জেদ নিয়েই দিল্লিতে নানা দলের নেতাদের বাড়ি ছুটে বেরিয়েছেন মুলায়ম। সিপিএমের দিল্লিবাসী এমন কোনও নেতা ছিলেন না, যাঁকে মুলায়ম হাত জোর করে অনুরোধ করেছেন, জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে অনুমতি দিতে। জ্যোতিবাবুর প্রতি ছিল এতটাই শ্রদ্ধা, ভরসা। নেতাদের অনেকের ধারণা, তীব্র কংগ্রেস বিরোধী মুলায়ম ২০০৮-এর ঐতিহাসিক অনাস্থা ভোটে ইউপিএ সরকারকে লোকসভায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন জ্যোতিবাবুর ইশারায়। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে বিবাদের জেরে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সিপিএম-সহ বাম দলগুলি। দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত ছিলেন না জ্যোতিবাবু।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা ছিল মুলায়মেরও। কংগ্রেসের বাধায় সেই সুযোগ দু’বার হাতছাড়া হয় উত্তরপ্রদেশের ‘নেতাজি’র। উত্তরপ্রদেশের মানুষ তাঁকে ‘নেতাজি’ বলেই জানে।

জনতা পার্টি-জনতা দল শিবির থেকে বেরিয়ে নিজের দল গড়াও ছিল মুলায়মের কুস্তিগিরের মেজাজের প্রতিফলন। পরিবারের সঙ্গে রাজনীতির বিন্দুমাত্র যোগ ছিল না। ছিলেন তেমন ওজনদার পথ-প্রদর্শক নেতাও। রাজনীতিতে আসা, প্রতিষ্ঠা পাওয়া, সবই নিজের চেষ্টায়। ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু করে নিজের দল তৈরি, সাত বারের সাংসদ, নয়বারের বিধায়ক এবং তিনবার মুখ্যমন্ত্রী, তিনবার কেন্দ্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, রাজনীতিতে বিরল কেরিয়ার গো-বলয়ের যাদব নেতার।

বিশ্বনাথ প্রতাপের মণ্ডল রাজনীতিকে হাতিয়ার করে বিহারে লালুপ্রসাদ, উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিং যাদবেরা যে জাত রাজনীতির নয়া সমীকরণ নির্মাণ করেছেন, সেই ভোট ব্যাঙ্কের সিন্দুক ভাঙতেই বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দলকে আজ উচ্চবর্ণের তকমা ছেড়ে দলিত, আদিবাসী, ওবিসি-দের বুকে টেনে নিতে হচ্ছে। ১৯৯০-এ সেই বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অযোধ্যা অভিযান রুখে দিয়ে সেবার বাবরি মসজিদ রক্ষা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম।
খবর দ্য ওয়ালের/এনবিএস/২০২২/একে