এনবিএস ওয়েবডেস্ক প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর, ২০২২, ০৩:১২ পিএম
শুভেন্দুকে ১০০ নম্বরের প্রশ্ন তৃণমূলের! উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতের ‘অ-কাজ’ সবিস্তারে ব্যাখ্যা করুন
একশো দিনের কাজ প্রকল্পে দিল্লির থেকে বাংলার বকেয়া পাওনা ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তা চেয়ে নবান্ন (TMC) যখন লাগাতার মোদী সরকারের কাছে জবাব চাইছে, তখন অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari)। দিল্লি চুপ থাকলেও শুভেন্দু বারবার পরিসংখ্যান দিয়ে দাবি করছেন, বাংলায় একশো দিনের কাজে চুরি হয়েছে। সেই চুরি বন্ধ না হলে দিল্লি যাতে টাকা না দেয় সে কথা তিনি নাকি মোদীর মন্ত্রী গিরিরাজ সিংকে জানিয়েও এসেছেন।
পরিস্থিতি যখন এমনই, তখন শুভেন্দুর উদ্দেশে কার্যত একশো নম্বরের প্রশ্ন ছুড়ল তৃণমূল। শুভেন্দুর সংখ্যাতত্ত্বের জবাব বাংলার শাসক দলও সংখ্যা দিয়েই দিয়েছে। এবং তা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতে তথাকথিত ভুয়ো জব কার্ডের তালিকা বাংলার তুলনায় কত গুণ লম্বা। তা হলে উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাতের টাকা কেন আটকে রাখছে না দিল্লি? তার মানে কি এটাই, যে রাজনৈতিক ভাবে পেরে না উঠে বাংলার টাকা আটকে শায়েস্তা করতে নেমেছে মোদী সরকার তথা বিজেপি।
একশো দিনের কাজ নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে সদ্য। বাংলার বকেয়া পাওনা নিয়ে লোকসভায় প্রশ্ন করেছিলেন তৃণমূলের ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রশ্নের লিখিত জবাব দিয়েছে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। তাতে দেখা যাচ্ছে, একশো দিনের কাজ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বাংলার টাকা আটকে রেখেছে দিল্লির সরকার। গত আর্থিক বছর আর চলতি বছর মিলিয়ে প্রকল্পে সামগ্রী খরচবাবদ ২৬৮৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের। দুই আর্থিক বছরে মজুরি বাবদ বকেয়া রয়েছে ২৭৪৮ কোটি টাকা।
অভিষেক সংসদের ওই উত্তর টুইট করার পর, তাঁকে মেনশন করে শুভেন্দু পাল্টা টুইট করেছেন। তিনি কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের একটি বিবৃতি টুইট করে দাবি করেছেন, ৪ লাখ ভুয়ো কার্ড বাতিল করা হয়েছে বাংলায়। এই ভুয়ো জব কার্ড দেখিয়েই একশো দিনের কাজে বাংলায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার চুরি হয়েছে।
এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে। তা হল শুভেন্দু সরকারের যে স্টেটমেন্ট টুইট করেছেন, তাতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, কেন ওই ৪ লক্ষ জব কার্ড বাতিল হয়েছে। এমন নয় যে সবই ভুয়ো। কোনও মজুর কোনও পঞ্চায়েত এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলে, ডুপ্লিকেট জব কার্ড থাকলে, জব কার্ডে ভুল থাকলে, কোনও গ্রামীণ এলাকার চরিত্র বদলে শহর হয়ে গেলে এবং কেউ কাজ করে না চাইলে তালিকা থেকে নাম বাদ যাবে। সুতরাং চার লক্ষ জব কার্ডের সবটাই যে ভুয়ো, তা কেন্দ্রও বলছে না।
এই ঠিক এই জায়গাতেই শুভেন্দুকে চেপে ধরতে চেয়েছে তৃণমূল। রাজ্যের শাসক দলের তরফ থেকে টুইট করে এদিন কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। সেগুলোও সম্ভবত কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এনআরইজিএ ওয়েবসাইট থেকেই পাওয়া। তাতে দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক বেশি মজুরের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে বাদ গেছে প্রায় ১৪ লক্ষের মতো। মধ্যপ্রদেশে ৭ লক্ষেরও বেশি নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যে জব কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ডের সংযুক্তি করতে পারেনি বাংলার থেকে অনেক বেশি মানুষ। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে সেই সংখ্যা যথাক্রমে ৮০ লক্ষ ও ৭৯ লক্ষ মতো। গুজরাতে ৩৩ লক্ষ। আর বাংলায় ২৭ লক্ষ।
ব্যাপারটা এখানেও থেমে নেই। কেন্দ্রের পরিসংখ্যান থেকেই দেখা যাচ্ছে ২০১৭-১৮ আর্থিক বছর থেকে চার বছরে এই প্রকল্পে গোটা দেশে ৯৩৫ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তামিলনাড়ুতে। সেখানে ২৪৫ কোটি টাকা চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ। অন্ধ্রে এই প্রকল্পে তছরূপ হয়েছে ২৩৯ কোটি টাকা। এবং বিহার ও ঝাড়খণ্ডে যথাক্রমে ১২.৩৪ কোটি ও ৫১.২৯ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। অথচ এই রাজ্যগুলির জন্য টাকা রিলিজ করা হলেও বাংলার জন্য বরাদ্দ অনুমোদন করা হচ্ছে না। তৃণমূলের বক্তব্য, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে রাজনৈতিক অবরোধ নয় তো কী?
বস্তুত একশো দিনের কাজ নিয়ে কমবেশি সবরাজ্যেই অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এর আগে মধ্যপ্রদেশের সেন্ধওয়াতে বিজেপির এক নেতা একশ দিনের কাজে ৫ কোটি টাকা চুরি করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ওখানে বিজেপিরই সরকার চলছে। আরও মজার বিষয় হল, মধ্যপ্রদেশের ঝির্নিয়া এলাকায় দীপিকা পাড়ুকোন এবং জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজের মতো অভিনেত্রীদের নামে জব কার্ড বানিয়ে টাকা তোলার অভিযোগও রয়েছে। আবার সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের বাগপত এবং মোরাদাবাদে একশ দিনের কাজে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। কোথাও ভুয়ো মাস্টাররোল বানানো হয়েছে তো কোথাও কাজ না করিয়ে টাকা তোলার অভিযোগ রয়েছে।
সমাজকর্মীদের অনেকের মতে, একশো দিনের কাজে দুর্নীতির আশঙ্কা প্রকল্প শুরুর সময় থেকেই ছিল। সেই ছিদ্র বন্ধ করার প্রয়াস চলছে। কিন্তু সেই চেষ্টা চালানোর সময়ে কোনও রাজ্যের জন্য বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া ঠিক কথা নয়। কারণ, সেক্ষেত্রে গরিব মজুরদেরই দুর্ভোগ পোহাতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, কাজ হয়ে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে মজুরদের মজুরি দেওয়া এই প্রকল্পে বাধ্যতামূলক। সেই অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এনআরইজিএ আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে, মজুরি দিতে ১৫ দিনের বেশি দেরি হলে প্রতি দিন ০.৫ শতাংশ করে সুদ দিতে হবে সরকারকে। প্রশ্ন হল, সেই টাকা কে দেবে?
খবর দ্য ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/একে