ঢাকা, শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫ | ৬ বৈশাখ ১৪৩২
Logo
logo

একটি ভবনের নামেই সীমাবদ্ধ ভাষা শহীদ রফিকের প্রেক্ষাপট!


এনবিএস ওয়েবডেস্ক   প্রকাশিত:  ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ০৫:০২ পিএম

একটি ভবনের নামেই সীমাবদ্ধ ভাষা শহীদ রফিকের প্রেক্ষাপট!

 একটি ভবনের নামেই সীমাবদ্ধ ভাষা শহীদ রফিকের প্রেক্ষাপট!

ভাষাশহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্র হলেও তার স্মৃতি রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেই প্রতিষ্ঠানটিতে। এমনকি ফেব্রুয়ারি মাসেও এই ভাষা সৈনিককে নিয়ে কোন আয়োজন হয়না জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

 রফিকের নামে কোন স্মৃতিস্তম্ভ,ভাস্কর্য কিংবা স্মৃতি স্থান নেই এখানে। কেবল একটি ভবনের নামেই যেন সীমাবদ্ধ তার প্রেক্ষাপট। জাতীয় দিবসগুলো নানান আয়োজনে উদযাপন করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো এই ভাষা শহীদের জন্ম ও শাহাদাতবার্ষিকীও পালন হয়না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি এই ভাষা শহীদের স্মৃতি ও প্রেক্ষাপট সবার সামনে তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য রফিকউদ্দিনকে নিয়ে ভাষার মাসে (ফেব্রুয়ারি) ও অন্যান্য সময়ে আলোচনা,স্মরণ সভা,সেমিনার আয়োজন করার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা যেতে পারে।

জানা যায়, রফিকউদ্দিন আহমদ ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জের সিংগাইরের পারিল বলধারা গ্রামে (বতর্মানে রফিকনগর) জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুল লতিফ মিয়া এবং মায়ের নাম রাফিজা খাতুন। ভাষা আন্দোলনের সময়  তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। তিনি ১৯৪৯ সালে বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন রফিক। পরে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়েন। ১৯৫০ সালে সেখান থেকে আইএ পরীক্ষা দিয়ে বাবার প্রিন্টিং ব্যবসা দেখাশোনার জন্য তিনি ঢাকায় চলে আসেন। এরপর জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।

রফিক দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগে পড়ালেখা করেছেন। তিনি জগন্নাথ কলেজের অনিয়মিত অর্থাৎ সান্ধ্যকালীন কোর্সের ছাত্র ছিলেন বলে জানা যায়। ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন রফিক, কিন্তু দিন কয়েক পরই পানু বিবির সঙ্গে রফিকের বিয়ে হয়। তাই ছেলেকে মিছিলে যেতে মানা করেন বাবা লতিফ মিয়া।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বিয়ের শাড়ি-গয়না নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার কথা ছিল রফিকের, কিন্তু বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জগন্নাথ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলে যান তিনি। সেই মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে গুলি চালায় পুলিশ। এতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রফিকের।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্ব দিকে তার মরদেহ পড়ে ছিল। ছয়-সাত জন ধরাধরি করে তার মরদেহ অ্যানাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন। তাদের মাঝে ডা. মশাররফুর রহমান খান গুলিতে ছিটকে পড়া রফিকের মগজ হাতে করে নিয়ে যান।

জনরোষের ভয়ে ওই দিন রাত ৩টায় সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে রফিকের মরদেহ দাফন করে পাকিস্তান সরকার। সেই কবরের কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি।

পরবর্তীতে ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার শহীদ রফিককে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। সরকারিভাবে ২০০৬ সালে তার ‘পারিল’ গ্রামে শহীদ রফিকের নামে ‘ভাষা শহীদ পাঠাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ স্থাপন করা হয়। সেখানে তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও প্রচুর বই আছে।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে পুরোনো বিজনেস স্টাডিজ ভবনের নাম পরিবর্তন করে ‘ভাষাশহীদ রফিক ভবন’ নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদভুক্ত বাংলা ও ইতিহাস বিভাগ ও মেডিক্যাল সেন্টার রয়েছে।

 এই এক ভবন ছাড়া আর কোথাও নেই তার স্মৃতিফলক কিংবা ভাস্কর্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক আবু সালেহ সেকেন্দারের ‘ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে শহীদ রফিকের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে। সবার মাঝে ভাষা শহীদ রফিক ও ভাষা আন্দোলনের চেতনা ছড়িয়ে দিতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে ভাষা শহীদ রফিক স্মৃতি পরিষদ।

প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারী যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে সেখানে খোদ ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিনকে নিয়ে থাকেনা বিশেষ কোন আয়োজন। এছাড়াও রফিকউদ্দিনের পরিবারের সাথেও কোন যোগাযোগ নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের।

রফিকউদ্দিনকে আরও  মর্যাদায় ভূষিত করার দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাঈম উদ্দীন বলেন, ভাষাশহীদ রফিককে স্মরণ কিংবা তাকে নিয়ে কোন আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়না। যেহেতু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) শিক্ষার্থী ছিল ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন তাই আমরা তার স্মরণে প্রতিবছর ভাষা আন্দোলনের উপর কুইজ ও রচনা প্রতিযোগিতা ও স্মরণ সভা আয়োজন করা যেতে পারে।

ভাষাশহীদ রফিক স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক রকি আহমেদ বলেন, ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ। অথচ তার নামে শুধু একটি ভবন ছাড়া কিছুই নেই। তার কোন ম্যুরাল নেই। বা স্মৃতি রক্ষার্থে কোন কর্ণার বা গবেষণা কেন্দ্র নেই। তাদের পরিবারে যারা জীবিত আছে তাদের কোন খোঁজও নেয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দাবি, ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান তথা প্রথম ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের স্মৃতি রক্ষার্থে গবেষণা কেন্দ্র বা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির নামকরণ রফিকের নামে করা হোক।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. ইব্রাহীম ফরাজী বলেন, ভাষাশহীদ রফিকউদ্দিন বাঙালি জাতির সূর্যসন্তান। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভবন আছে ভাষা শহীদ রফিকের নামে৷ তবে তার স্মৃতি রক্ষায় আরও উদ্যোগ নেয়া জরুরি। নতুন ক্যাম্পাসে যেন তার স্মৃতি রক্ষায় আরও ব্যবস্থা নেয়া হয় সেজন্য উপাচার্য স্যারের সাথে কথা বলব।

 বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শহীদ রফিককে নিয়ে বিশেষ কিছু নেই৷ শুধু একটি ভবন আছে তার নামে৷ এটি কেন্দ্রীয়ভাবে করা হয়েছে। তবে তার স্মৃতিকে বিস্তৃত করা উচিত।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিনকে স্মরণ করা উচিত। তার স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি তাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।

 এনবিএস/ওডে/সি