গত ৯ জানুয়ারি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্র্বতী সরকার নতুন করে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। এই পদক্ষেপের ফলে জনজীবনে বিশেষভাবে প্রভাব পড়েছে। কর্মজীবী মানুষ যেমন ইমাম হোসেন, যারা বলছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে তাদের সংসারের ওপর চাপ বেড়ে গেছে, তেমনি বিক্রেতারাও ভোগান্তিতে পড়েছেন। ঢাকার সেগুনবাগিচার ফল বিক্রেতা আতিকুল ইসলাম জানাচ্ছেন, ফলের দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে গেছে এবং ক্রেতারা কম পরিমাণে কিনছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনীতির এই অস্থিতিশীলতা এবং ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দেশের সাধারণ জনগণের জন্য আরেকটি বড় দুঃসংবাদ। তারা বলছেন, এর ফলে বেকারত্ব বাড়বে এবং মানুষ আরও ঋণগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ‘অবিবেচনাপ্রসূত’, কারণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপগুলো খুব একটা কার্যকরী হয়নি। তাদের মতে, অন্তর্রতী সরকারের এই পদক্ষেপ পরিস্থিতি আরও খারাপ করবে এবং দারিদ্র্যের হার বাড়াবে।

বিভিন্ন পণ্যের দাম ইতোমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে পোশাক, ওষুধ, সিগারেট, এবং বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে মিষ্টি, ফলের রস, এলপি গ্যাস, বিস্কুট, সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড জানিয়েছে, কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর দাম আগের জায়গায় ফিরে আসেনি। একদিকে সরকার বলছে যে এটি রাষ্ট্র রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে এই সিদ্ধান্ত দেশের জন্য আরও ক্ষতিকর হবে।

আইএমএফের পরামর্শে সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে আইএমএফ এবং সেই ঋণ ছাড় করার জন্য ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদজনক হতে পারে। তিনি বলেন, ‘যখন রাষ্ট্রের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল, তখন সরকার কেন পরোক্ষ করের ওপর জোর দিল?’

এছাড়া, অর্থনৈতিক গবেষক মাহা মির্জা বলছেন, সরকার যখন ভ্যাট বৃদ্ধি করেছে, তখন তা দেশের শ্রমিক শ্রেণী এবং সাধারণ জনগণের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে। তিনি মনে করেন, এতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, যা আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি করবে।

এদিকে, বাংলাদেশে এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, নতুন ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে প্রান্তিক কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য যেমন—আম, টমেটো, আনারস প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা পণ্যগুলোর ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে, যার ফলে এসব কৃষিপণ্য বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে।

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, ‘রাষ্ট্রকে বাঁচানোর জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, সরকারের জন্য বর্তমানে এমন পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য ছিল। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে অর্থনীতিবিদরা এই সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করেছেন।

তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ পাওয়া যায়নি। বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সরব হলেও, কোনো বড় আন্দোলন বা কর্মসূচি হাতে নেয়নি।

এই পরিস্থিতিতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত জনগণের জন্য কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু একথা ঠিক, যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে যাবে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

news