পর্যালোচনা চলাকালে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ ধারা কার্যকর বন্ধ থাক, কেন্দ্রকে বলল সুপ্রিম কোর্ট

অবস্থান বদল করে সোমবার কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে (Supreme Court) জানিয়েছিল, তারা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪ এ ধারাটির প্রয়োজনীয়তা পর্যালোচনা করে দেখতে চায়। নাগরিকের কোন কোন আচরণ, বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহ (Sedition Law) বলে বিবেচিত হবে এবং সাজার বিধান ওই ধারায় বলা আছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী এবং নাগরিক সমাজের অনেকেই মনে করেন পরাধীন দেশে ব্রিটিশ সরকারের তৈরি ওই আইনি বিধান আইনের শাসনের পরিপন্থী। খোদ ব্রিটেনেই সমগোত্রীয় ধারা, বছর পঞ্চাশ আগে বাতিল হয়ে গেছে। এদেশেও তা বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে গুচ্ছ মামলা হয়েছে।

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এনভি রামানার (NV Ramana) বেঞ্চ কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতার কাছে জানতে চায়, ধারাটি পর্যালোচনা করতে কেন্দ্রীয় সরকার কতদিন সময় নেবে? এক মাস, দু’মাস, তিন মাস? কতদিন? আপনারা স্পষ্ট করে সেটা আদালতকে বলুন। কতদিন এই ধারা বাতিলের দাবি নিয়ে হওয়া মামলার শুনানি আদালতকে বন্ধ রাখতে হবে?
 
বিচারপতি সূর্যকান্ত সলিসিটর জেনারেলকে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার কি পর্যালোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধারাটি কার্যকর স্থগিত রাখতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেবে? পর্যালোচনা চলাকালে ওই ধারায় হওয়া চলতি মামলাগুলির কী হবে? কেন্দ্র কেন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ধারাটি পর্যালোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর স্থগিত রাখার কথা জানাচ্ছে না? 
সুপ্রিম কোর্ট আগামীকাল বুধবারের মধ্যে কেন্দ্রকে এই ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত আদালতকে জানতে নির্দেশ দিয়েছে। ফলে আগামীকালই স্পষ্ট হতে পারে রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত ধারাটির নিকট ভবিষ্যত কী হতে চলেছে।
দিন তিনেক আগেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার জানিয়েছিল তারা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪ এ ধারাটি বহাল রাখার পক্ষে। যে ধারায় নাগরিকদের বিশেষ কিছু আচরণ, মন্তব্য ইত্যাদিকে দেশ বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। জামিন অযোগ্য ওই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
সোমবার কেন্দ্রের তরফে অবস্থান বদলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এনভি রামানার ডিভিশন বেঞ্চে জানানো হয়েছে তারা ধারাটি পর্যালোচনা করে দেখতে আগ্রহী। কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বরাবর রাজনৈতিক অধিকার, মানবাধিকার রক্ষার পক্ষে। তিনি চান মানুষ সাংবিধানিক অধিকারগুলি থেকে যেন বঞ্চিত না হয়। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ধারাটির প্রয়োজন খতিয়ে দেখার পক্ষপাতী। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে ধারাটির কোনও অংশ আপত্তিজনক কিনা বিভিন্ন ফোরামে সেটি নিয়ে আলোচনা করে বিভিন্ন মত শুনে নিতে চায় কেন্দ্র।
রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ তো বটেই, সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি এর আগে প্রশ্ন তুলেছেন, দেশ যখন স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ উদযাপন করছে তখন ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারাটির আর কী প্রয়োজন? ওটা তো ব্রিটিশ ভারতীয়দের উপর দমনপীড়নের জন্য চালু করেছিল। স্বাধীন দেশে এর প্রয়োজন কোথায়?

ওই ধারা নিয়ে বিতর্কের জেরে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা বিচারাধীন। বৃহস্পতিবার সেই সংক্রান্ত একটি মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেল কেকে বেনুগোপাল সরকারের বক্তব্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন, ধারাটির অবশ্যই প্রয়োজন আছে। প্রয়োজনে সেটির প্রয়োগ নিয়ে একটি বিধিমালা তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু বাতিল করা ঠিক হবে না।
ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারায় কী বলা হয়েছে? (Sedition Law)
কোন কোন অপরাধ বা আচরণ রাষ্ট্রদোহিতা বলে ধরা হবে, ওই ধারায় তা বিশদে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে সাজার বিধান। রাষ্ট্রের প্রতি কোনওভাবে ঘৃণা বা বিদ্বেষ পোষণ এককথায় রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ বলে গণ্য হয়ে থাকে। বিদ্বেষ বলতে বোঝাবে অসম্মান, শক্রতামূলক আচরণ এবং আনুগত্যহীনতা প্রদর্শন। 
এই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা হল যাবজ্জীবন কারাবাস এবং ধারাটি জামিন অযোগ্য। অর্থাৎ বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাবাস চলবে। মুক্তি সম্ভব একমাত্র বিচার শেষে নির্দোষ ঘোষিত হলে। 

জমানা নির্বিশেষে এই ধারার অপপ্রয়োদের অভিযোগ উঠেছে। মোদী সরকারের জমানায় তা মাত্রা ছাড়িয়েছে বলে নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলির বক্তব্য। অভিযোগ, সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্র বিরোধিতা বলে চালানো হচ্ছে। মানবাধিকার হরণের অভিযোগ তোলা মাত্র দেশ বিরোধী তকমা দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহের ধারা দিয়ে জেলে পোরা হচ্ছে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকজনকে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি অবিজেপি শাসিত রাজ্যের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ রয়েছে। তবে উত্তরপ্রদেশ-সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি।

 এদিন শুনানি চলাকালে বর্ষীয়ান আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, সরকার ও রাষ্ট্রকে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার গুলিয়ে ফেলছে। দুটো এক নয়। তাঁর বক্তব্য, সরকারের সমালোচনা কেন রাষ্ট্র বিরোধী বলে চালানো হবে?

গত শনিবার কেন্দ্রের তরফে বলা হয়েছিল, ধারাটির নতুন করে আর পর্যালোচনা করার সুযোগ নেই আদালতের নেই। কারণ, ১৯৬২ সালেই সুপ্রিম কোর্ট ধারাটি বহাল রাখার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু দুদিন পরেই মত বদলে মোদী সরকার জানাল তারা ধারাটির পর্যালোচনায় আগ্রহী। এখন সর্বোচ্চ আদালত জানতে চাইল, কতদিন লাগবে পর্যালোচনায়?  খবর পার্সটুডে/এনবিএস/২০২২/একে

news