বাড়িতে স্ত্রী-মাকে পেটালে তাড়াবে সিপিএম, গঠনতন্ত্রে যোগ হল ধারা
প্রয়াত কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত অনেকদিন আগে লিখেছিলেন—“গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে মেয়েগুলি শুধু
ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে……… আপনি বলুন মার্ক্স,
মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে ?”
ছেলেরা বিপ্লবের কথা বলবে, আর মেয়েরা তাঁদের যত্নআত্তি করবে—বাম তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনে লিঙ্গের বেড়াজাল ভাঙতে ‘আপনি বলুন মার্ক্স’ লিখেছিলেন মল্লিকা। গার্হস্থ্য হিংসা যখন মারণরোগের মতো জাঁকিয়ে বসেছে, তখন সে ব্যাপারে দলের পুরুষ সদস্যদের সবক শেখাতে পার্টি গঠনতন্ত্রে নতুন ধারা আনল সিপিএম (CPM)।
সদ্যসমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসে নতুন দুটি ধারা সংযোজন করেছে সিপিএম। সেখানে ১৪ অনুচ্ছেদের ৩-এর উপধারায় বলা হয়েছে, “গার্হস্থ্য হিংসা এবং ওই ধরনের কোনও আচরণ যৌন নিগ্রহ হিসেবে বিবেচিত হবে।” অর্থাৎ সিপিএমের কোনও পুরুষ সদস্য যদি বাড়িতে স্ত্রী, মা, বোন, দিদির উপর শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করেন তাহলে দলের কাছে অভিযোগ জানালে কোনও রেয়াত করা হবে না। তদন্ত কমিশন সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখবে। প্রমাণ হলে সরাসরি পার্টি বহিষ্কার করবে।
সিপিএমের এক নেতার কথায়, “গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে এর আগে পার্টিতে অভিযোগ এসেছে, অনেকে বহিষ্কারও হয়েছে। কিন্তু এটা পার্টি গঠনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ ছিল না। এবার তা করা হয়েছে।” এখন জেলায় জেলায় সিপিএম নেতারা পার্টি কংগ্রেসের আলোচনার নির্যাস নিয়ে রিপোর্টিং সভা করছেন। সেখানেই স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হচ্ছে গঠনতন্ত্র পরিমার্জনের কথা।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক তথা সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেছেন, “সিপিএম দল যেটা করল, এটা অত্যন্ত সময়োচিত পদক্ষেপ। আমি মনে করি এটা সর্বত্র একটা উদাহরণ তৈরি করবে। রাজনৈতিকদলগুলির ক্ষেত্রে আমাদের একটা বক্তব্য ছিল। তাঁরা বাইরে এক ধরনের আচরণ করেন আর ঘরের ভিতর আরএক ধরনের আচরণ করেন।”
শাশ্বতী মনে করেন, পার্টি কাঠামোর মধ্যে অভিযোগ জানানোর একটা নির্দিষ্ট পরিসরও থাকা উচিত। তাঁর কথায়, “এই ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে যেন সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া বা ইত্যাদি না হয়।” অর্থাৎ কঠোর পদক্ষেপের কথা তিনি বলেছেন। তিনি আরও বলেন, “যখন ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ক্ষমতায় ছিল সেই সময়ে এটা করলে আরও ভাল হতো।”
সিপিএমের পার্টি কর্মী তথা বিদ্যালয় শিক্ষা স্তরের কর্মী উর্বা চৌধুরী বলেন, “গার্হস্থ্য হিংসার প্রশ্নে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও ভরসাযোগ্য। পার্টি পরিসরের বাইরেও সামাজিক ক্ষেত্রে এর একটা সিরিয়াস ইতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে।” তিনি আরও বলেন, “নারী অধিকারের যে লড়াই চলছে তাতে চরাই-উতরাই রয়েছে। চাপানউতোরও বিদ্যমান। এখন অনেক বেশি মহিলা বাইরে বেরোচ্ছেন। প্রত্যয় বাড়ছে। ফলে আগের চেয়ে, অভিযোগ জানানোর ঘটনা ঘটছে বেশি। এমতাবস্থায় এ জাতীয় ধারার ফলে নারীর ক্ষমতায়ন না ঘটে গেলেও, সেদিকে একটা গুরুতর পদক্ষেপ হবে। আমার মনে হয় গঠনতন্ত্র পরিমার্জনের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পার্টির মধ্যেকার পরিবেশও এতে অনেক বেশি ক্লেদমুক্ত হবে।”
ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাধুবাদযোগ্য। গার্হস্থ্য হিংসা বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের প্রশ্নে আমার মনে হয় রাজনৈতিকদলগুলির আরও কঠিন অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। কারণ যিনি বাড়িতে এই কাণ্ড করেন তিনি যদি ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধি হন তাহলে সামাজিক ক্ষেত্রে বিপদের একটা ঝুঁকি রয়েছে। খবর দ্য ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/একে