বিষ খাইয়ে মারতে চেয়েছিল বাবা, প্রথমবার মঞ্চের স্বাদ দিয়েছিল কলকাতা
ছোট্ট দুই যমজ বোনের হাতে আদর করে মেঠাই তুলে দিয়েছিল অচেনা দুটো লোক। সরল মনে সেই মিষ্টি মুখে তোলা মাত্র ছটফট করে ওঠে বোন। ছোট্ট নরম শরীরটা যন্ত্রণায় নীল হয়ে আসে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই সব শেষ। ঘাতকের এনে দেওয়া বিষ মেশানো মিষ্টি মুখে না তোলায় সেদিন কপালগুণে বেঁচে গেছিল চার বছরের ছোট্ট বিবি। বোন জোহরাকে শেষ দেখাটুকু দেখারও সুযোগ মেলেনি তার। কান্নামেশানো প্রশ্নের উত্তরে পাথরের মতো চোখ নিয়ে মা বলেছিল, ‘বোন আল্লার কাছে বেড়াতে গেছে’… কপালজোরে বেঁচে যাওয়া সেই ছোট্ট মেয়েটা জানতেও পারেনি তাদের মেরে ফেলার সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে সামিল ছিল তাদের নিজেদের বাবাও। বনেদি সৈয়দ বংশের সেই পথের কাঁটা, গরিব মায়ের মেয়ে বিবি আর কেউ নয়, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের সাক্ষাৎ সরস্বতী বেগম আখতার (Begum Akhtar)।
উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার এক অখ্যাত শহরে জন্ম আখতারি বাঈ ফৈজাবাদির। ছোট থেকেই লড়াই করে বেড়ে ওঠা তাঁর। আখতারির মা মুস্তারির প্রেমে পড়েছিলেন বাবা আসগর হুসেন৷ বিয়েও করেন। কিন্তু তারপরই শুরু হয় অসম্মান আর অস্বীকার। আসগর হুসেন ব্রিফলেস ব্যারিস্টার হলেও সৈয়দ বংশের সন্তান; আর অসামান্য সুন্দরী হলেও মুস্তারি তো বাজারি মেয়ে, তওয়াইফ৷ এ বিয়ে মেনে নিলে পরিবারের মুখ ছোট হবে যে! তাই বিয়ের কিছু দিন পরই শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় মুস্তারিকে। সদ্যোজাত দুই মেয়েকে নিয়ে পেটের টানে পথে নামেন মা। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই মেলে না। বিষ মেশানো মিষ্টি খেয়ে কিছুদিন পরই মারা যায় ছোট মেয়ে জোহরা। আখতারি বরাতজোরে বেঁচে গেলেও মা-মেয়েকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয় তারপরেও। এবার ভয় পেয়ে যান মা মুস্তারি। ছোট্ট বিবির হাত ধরে ফৈজাবাদ থেকে পালিয়ে চলে আসেন গয়া।
মায়ের সঙ্গে কিশোরী আখতারি
ইস্কুলে যেতে ভালো লাগত না বিবির। তাঁকে টানত সুর, ভালো লাগত সারাদিন রেওয়াজ করতে৷ আর ভালো লাগত গান শুনতে। ঠুমরি, গজল, মার্গসংগীতের নন্দনকানন তখন কলকাতা। সেই কলকাতারই এক অনুষ্ঠানে গান শুনতে এসে কপালে শিকে ছিঁড়ল ১১বছরের ছোট্ট মেয়ের। শিল্পীদের অনুপস্থিতিতে খানিক বাধ্য হয়েই উদ্যোক্তারা মঞ্চে তোলে তাঁকে। সেদিন একের পর এক গান গেয়ে শ্রোতাদের মাতিয়ে দিয়েছিলেন ১১ বছরের ছোট্ট আখতারি বিবি (Begum Akhtar)।
পাটনার সারেঙ্গি বাদক ইমদাদ খানের কাছে প্রথম নাড়া বেঁধে গান শেখা শুরু। তারপর একে একে মোহাম্মদ খান, আবুল ওয়াহেদ খান,গয়ার জমির খাঁ, জুন্দা খাঁ, উস্তাদ বরকত আলি খাঁ- মার্গ সংগীতের দিকপালদের কাছে তালিম নেন আখতারি। কলকাতায় বসে গান শিখেছেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও।
ছোট্ট বয়স থেকেই শ্রোতাদের মন কেড়ে নিয়েছিল আখতারি বাইয়ের গলার অলীক জাদু। মেগাফোন সংস্থার সঙ্গে চুক্তিতে গেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত গান “দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো দিওয়ানা বানা দে”… এই একটা গানই রাতারাতি দেশের সঙ্গীতরসিক মহলে জনপ্রিয় করে দিয়েছিল কিশোরী আখতারিকে (Begum Akhtar)।
গান শুধু দেয়নি, নিয়েছেও অনেক। চেনা লোকের হাতেই যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন, একাধিকবার। তওয়াইফের মেয়ে, এই পরিচয় মুছে শিল্পীর পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন, চেয়েছেন ঘর-বর, স্বাভাবিক দাম্পত্য। প্রেমের বিয়ে, তাও শর্ত ছিল প্রকাশ্যে গান গাওয়া যাবে না। মেনেও নিয়েছিলেন আখতারি। কিন্তু সুর যার শিরাধমনীতে বইছে, তাকে গানের থেকে আলাদা করা কি সম্ভব? তাই বিয়ের কবছর পরেই প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন আখতারি। ডাক্তার নিদান দিলেন, ওষুধ নয়, গানে ফিরুন। নিমরাজি হল শ্বশুরবাড়িও। আবার নতুন করে তানপুরো তুলে নিলেন বেগম আখতার। তারপর বাকিটা ইতিহাস…
খবর দ্য ওয়ালের/এনবিএস/২০২২/একে


