ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বিদ্বেষের রাজনীতি নিয়ে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার

ভারতে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ ও ‘বিদ্বেষের রাজনীতি’ ইস্যুতে ঘরে বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় আমলাদের একাংশ এক খোলা চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘সম্প্রতি দেশে যে বিদ্বেষের রাজনীতি চলছে, তার বলি শুধু সংখ্যালঘুরা নয়, বরং সংবিধানও।’
দিল্লির সাবেক উপ-রাজ্যপাল নাজিব জং, সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননসহ ১০৮ জন আমলার সই রয়েছে এই চিঠিতে। এ ধরনের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী সরব হবেন বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। 

গতকাল (বুধবার) দিবাগত রাতে এনডিটিভি হিন্দি ওয়েবসাইটে প্রকাশ, দিল্লির সাবেক লেফটেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘দেশে সাম্প্রদায়িকতার নতুন যুগ চলছে। সরকারের কাছ থেকে যে পদক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল তা হচ্ছে না, ডিএম-এসপি ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না, এটা উদ্বেগজনক! মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টানদের অন্তর্ভুক্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন শক্তিশালী নেতা, ভারত তার কথা শোনে। তিনি যদি একটা ইঙ্গিত দেন তাহলে এসব ঘটনা বন্ধ হবে। যদি বন্ধ নাও হয় তা কমে যাবে। এ সব চলতে পারে না, তাই আমরা এই চিঠি লিখেছি।’

তিনি বলেন, ‘এটা ভারতের জন্য ভালো নয় যে ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু নিরাপদ বোধ করে না।’  এক প্রশ্নের জবাবে দিল্লির সাবেক লেফটেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং বলেন, সর্দার প্যাটেল (ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী) দিল্লি দাঙ্গার সময় বলেছিলেন, আমি ২৪ ঘন্টার মধ্যে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে চাই, অন্যথায় এসপি-ডিএমকে দায়ী করা হবে। এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। সেজন্য এসপি ও কালেক্টরের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে তা ভুল হচ্ছে।’        

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে পাঠানো খোলা চিঠিতে দিল্লি, অসম, গুজরাট, হরিয়ানা, কর্নাটক, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সাবেক আমলারা লিখেছেন, ‘যা ঘটছে তা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতি এবং আইনের শাসনের পরিপন্থি। এখানে  ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ’ ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত পাচ্ছে।’  প্রসঙ্গত, উল্লিখিত প্রত্যেকটি রাজ্যই হিন্দুত্ববাদী বিজেপিশাসিত। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারেরই নিয়ন্ত্রণাধীন।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে নিজেদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস এবং সংস্কৃতি বজায় রাখতে পারেন, সে জন্য অবিলম্বে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষেও সওয়াল করেছেন সাবেক আমলারা। একইসঙ্গে আশাভঙ্গের কথা জানিয়ে তারা চিঠিতে লিখেছেন, ‘ঘৃণা ও বিদ্বেষের এই আবহে সংখ্যালঘুদের মনে ভীতি আরও প্রবল হচ্ছে।’  

দেশের সংখ্যালঘু, দলিত, দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ঘৃণার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে পরিকল্পিতভাবে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে ওই খোলা চিঠিতে। তাদের দীর্ঘ  অভিজ্ঞতার নিরিখে অবসরপ্রাপ্ত সাবেক আমলাদের দাবি, ‘সর্বোচ্চ স্তরের রাজনৈতিক অনুমোদন ছাড়া এমনটা ঘটা সম্ভব নয়।’ 
অন্যদিকে, গণমাধ্যমে প্রকাশ, মার্কিন কমিশন ‘কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে ভারতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে জানিয়েছে। এ নিয়ে পরপর তিন বছর ‘কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ তাদের রিপোর্টে জানাল, ভারতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এ জন্য ভারতের উপরে একগুচ্ছ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর সুপারিশও করেছে তারা।     

মার্কিন ওই কমিশনের রিপোর্টে ২০২১ সালে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উপরে ঘটে যাওয়া অসংখ্য সহিংসতার ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার তাদের হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবাদর্শে চলে যে নীতি প্রণয়ন করছেন, তা সংখ্যালঘুদের জন্য  প্রতিকূল।’ রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পাচ্ছে।’

ভারতকে ‘যথেষ্ট উদ্বেগজনক পরিস্থিতি’ তালিকায় রাখার সুপারিশ করে কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা থেকে সরকারের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা আমাদের যথেষ্ট উদ্বিগ্ন করেছে।’ 

 ২০২০ সালের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মার্কিন ওই কমিশনের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘ভারতকে ‘যথেষ্ট উদ্বেগজনক’ তালিকায় রাখতে চাওয়া ওই সংগঠনটিরই কার্যকলাপ যথেষ্ট উদ্বেগজনক।’  

ভারত অতীতে বলেছে,  আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর মার্কিন সংস্থাটি শুধুমাত্র তার পক্ষপাতিত্ব দ্বারা পরিচালিত হতে বেছে নিয়েছে এমন একটি বিষয় যাতে তাদের হস্তক্ষেপ করার কোনও অধিকার নেই।  

স্বাধীনদায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন ওই কমিশন বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি খতিয়ে দেখে আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতরকে রিপোর্ট দেয় এবং সেই দেশটির উপরে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিষয়ে সুপারিশ করে। তবে তাদের সুপারিশ মানার ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন বিগত দু’বছর ভারতের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি হোয়াইট হাউস। এবারও তারা সেই পথেই চলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরাখবর পার্সটুডের /এনবিএস/২০২২/একে

news