যাঁরা ছিলেন ওপারে

 গত বছর ২ মে। সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ যখন মোটামুটি ট্রেন্ড স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, সেই সময়ে ফেসবুক লাইভে এসে তৃণমূলের তরুণ নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য (Debangshu Bhattacharya) রাগ, আবেগ, আনন্দ মেশানো গলায় চিৎকার করেছিলেন। গলা ফাটিয়ে চিৎকার। যা করতে করতে গলা বুজে এসেছিল দেবাংশুর। হবে না? আগের রাত পর্যন্ত দেবাংশু, দেবাংশুদের মতো অনেককেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মেনশন করে বিজেপির তরুণজ্যোতি তিওয়ারির মতো নেতারা লিখছিলেন, “কাল দুপুরের পর খেলা শেষ।” শুধু কি তাই, এমন এমন টিপ্পনি ধেয়ে এসেছিল, যাতে মেশানো ছিল পরিমাণমতো হুমকি। দুশো পার করার গেরুয়া হুঙ্কার উড়িয়ে রেকর্ড আসন জিতেছিল তৃণমূল (BJP-TMC)।

আজ সোমবার সেই জয়ের একবছর। দেবাংশু মে দিবসেই নিজের আক্ষেপের কথা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। তা আবার ডিলিটও করেছিলেন। যে পোস্ট ডিলিট করেছিলেন দেবাংশু, তাতে লেখা ছিল, তৃণমূলে এখন ড্রেনের জল, গঙ্গাজল সব মিলেমিশে একাকার। এও লিখেছিলেন, গত বছর ১ মে পর্যন্ত তৃণমূলটা ছিল নিষ্কলুষ।

২ মে তৃণমূল জিতল। তারপর যা যা হল এই এক বছরে, যে গতিতে জার্সি বদল হল তা বোধহয় আটের দশকের কলকাতা ময়দানকেও হারিয়ে দেবে (BJP-TMC)।
৫ মে দিদি তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী (Mamata Banerjee) হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তারপর এক মাস তেমন কিছু বোঝা যায়নি। বিজেপি পার্টি অফিস ফাঁকা। জনমানবশূন্য। আর শুভেন্দু অধিকারীরা (Suvendu Adhikari) নিয়ম করে ভোট পরবর্তী হিংসার অভিযোগ করছেন। রাজভবনে যাচ্ছেন। কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অরবিন্দ মেননের ফোন বন্ধ। অমিত মালব্য টুইট করতেও কুণ্ঠা করছেন। এই যখন বিজেপির অবস্থা তখন দেখা গেল ১১ জুন হইহই। তৃণমূল ভবনের বাইরে ভিড়। সল্টলেকের বাড়ি থেকে ছেলে শুভ্রাংশুকে নিয়ে তপসিয়ার দিকে রওনা দিয়েছেন মুকুল রায় (Mukul Roy)।

যে অফিসে একটা সময়ে তিনিই ছিলেন শেষ কথা, সেখানে এলেন মুকুল। বীজপুরে বিজেপির টিকিটে হেরে যাওয়া ছেলেকে নিয়ে কৃষ্ণনগর উত্তরের বিজেপি বিধায়ক ঢুকলেন তৃণমূল ভবনে। যেখানে মুকুল রায়ের গাড়িটা দাঁড়াল তার ঠিক উপরেই ঝুলছিল ব্যানারটা, ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়।’

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee) দু’জনের গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন। মাইক হাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “মুকুল কিন্তু ইলেকশনের আগে আমাদের সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা বলেনি। ও আগে যে মর্যাদা নিয়ে ছিল এখনও সেই মর্যাদা নিয়েই থাকবে।”

 যদিও সেসব ফ্রেমের কতটা আইনি স্বীকৃতি রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, মুকুল রায় অন্যদলে গিয়েছেন এমন কোনও প্রমাণ নেই। তাই দলত্যাগ বিরোধী আইনে তাঁর বিধায়ক পদ খারিজেরও প্রশ্ন নেই। তা নিয়ে আবার এখন শুনানি প্রক্রিয়া চলছে।

মুকুল রায় দলে ফিরতেই দেবাংশুর উদ্দেশে ফের একাংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হতে শুরু করল। দেবাংশু বলেছিলেন, অন্য দল থেকে কেউ ফিরতে চাইলে আমি দরজার বাইরে শুয়ে পড়ব। কিন্তু দেবাংশু সুন্দর নিজেকে ডিফেন্ড করেছিলেন। মুকুল পর্বের পর তাঁর যুক্তি ছিল, “আমি তো বলেছিলাম ভোটের আগে যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন তাঁদের কথা!”

ফলে দেবাংশুর যুক্তিতে তিনি ঠিক। কারণ মুকুল রায় ভোটের আগে বিজেপিতে যাননি। গিয়েছিলেন ২০১৮ সালের নভেম্বরে। তাই তিনি ফিরতেই পারেন। কিন্তু তারপর আরও বড় ধামাকা অপেক্ষা করছিল বাংলার রাজনীতির জন্য।
জুন মাসে নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করলেন। বাদ পড়লেন বাবুল সুপ্রিয় (Babul Supriyo)। টুইট করে বাবুল জানিয়ে দিলেন, রাজনীতিতে আর থাকছেন না। এও জানালেন, তাঁর দুটি দল। এক, মোহনবাগান, দুই বিজেপি। পার্টি বদলের ব্যাপার নেই। পুজোর ঠিক আগে আগে বাবুল পৌঁছলেন ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে। যোগ দিলেন তৃণমূলে।

গত বছর মে মাসের ২ তারিখ বাবুল টালিগঞ্জে হেরেছিলেন বিজেপির হয়ে। এবছর ২ মে বাবুল বালিগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক। যদিও শপথ নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর টুইট যুদ্ধ চলছে। যে রাজ্যপাল একদিন এই বাবুলকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেট থেকে ‘ছাত্রদের ঘেরাটোপ’ ভেঙে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন।

বাবুলের ক্ষেত্রেও দেবাংশু ব্যাট চালিয়েই খেলেছিলেন। কারণ বাবুল তো কখনও তৃণমূলে ছিলেনই না। এই প্রথম তাঁর দলে যোগ দেওয়া। এটাকে বাবুলের আত্মোপলব্ধি হিসেবেই দেখাতে চেয়েছিল তৃণমূল। দেবাংশুও তাই।

কিন্তু এরপর সব্যসাচী দত্ত (Sabyasachi Dutta)। তারপর রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় (Rajib Banerjee)। যে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এও বলেছিলেন, ওঁর টাকা নাকি দুবাইয়ে খাটে। তারপর রাজীব ক্ষমা চেয়ে তৃণমূলের পতাকা হাতে নিলেন ত্রিপুরার মাটিতে। এখন তিনি ত্রিপুরা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক। সব্যসাচী এখন বিধাননগরের চেয়ারম্যান।

 
গত বছর ২ মে সুনসান বিজেপি দফতরে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন জয়প্রকাশ। কেউ ছিলেন না সামনে। মানুষের রায় মাথা পেতে নিয়েও জয়প্রকাশ বলেছিলেন, বহু কাউন্টিং সেন্টার থেকে আমাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল জিতল মানে তাদের বিরুদ্ধে কয়লা, বালি, পাথর চুরির অভিযোগ মিথ্যে হয়ে যায় না।” সেই জয়প্রকাশ এখন তৃণমূলের হয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন। রাজ্য তৃণমূলের সহ সভাপতিও তিনি।

এই এক বছরে আরও অনেক বিধায়ক, ছোট-মেজো নেতারা তৃণমূলে ফিরেছেন। যাঁরা প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন, বাংলায় রামরাজত্ব কায়েম হয়ে গিয়েছে।
অনেকের মতে, এই একটা বছর দেখিয়ে দিল রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না। যে কথাটা গতকাল, ১ মে রাতে বলেছেন অর্জুন সিং। এ বার তাঁকে নিয়েও কৌতূহলের ঘড়ি বাজছে—টিক টক টিক টক…।খবর দ্য ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/একে

news