‘জেনোসাইড জো’: যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভ বাইডেনের পুনর্নির্বাচনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে
জেনোসাইড জো, গাজায় কত শিশু হত্যা করেছো?’ ২৩ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভার্জিনিয়া রাজ্যে নির্বাচনি প্রচারণা অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার সময় ফিলিস্তিনপন্থী এক বিক্ষোভকারী চিৎকার তার ভাষণকে ব্যাহত করে।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে একশোরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুদ্ধ-বিরোধী বিক্ষোভের জোয়ারে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জো বাইডেন আগের চেয়ে আরও বেশি বাধার মুখে পড়ছেন বলে মনে হচ্ছে। এই বিক্ষোভে দুই হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে সশস্ত্র হামলা চালানোর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘জেনোসাইড জো’ নামটি ছড়িয়ে পড়ে।
২৮ অক্টোবরের মধ্যে ডেট্রয়েটে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভে যারা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এটি বহুল উচ্চারিত একটি স্লোগান হয়ে দাঁড়ায়।
যুদ্ধের প্রথম মাসগুলোয়, জো বাইডেন যখন ইসরায়েল সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেয়ার কথা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের আরব-মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং বাম-গণতান্ত্রিক ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, এ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। যা তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষের ঝড় বইয়ে দিয়েছে যারা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছে।
এই তরুণরা এবং তাদের কাছাকাছি দৃষ্টিভঙ্গির অন্যান্য সংখ্যালঘু যেমন: ল্যাটিনো, এশিয়ান, আফ্রিকান-আমেরিকান, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সদস্যরা মূলত ডেমোক্রেট পার্টির ভোটার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। এদের সমর্থন বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি করতে সক্ষম যা পেলে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবেন জো বাইডেন।
৭ অক্টোবরের হামলার পর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েল ভ্রমণ করেন এবং ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াসহ ওই অঞ্চলে হামাসের অন্যান্য মিত্ররা যেন সংঘাত বাড়াতে না পারে তা সতর্কতা হিসেবে ভূমধ্যসাগরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করেন।
ফিলিস্তিনিপন্থী গোষ্ঠীগুলি একটি সুনির্দিষ্ট যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও, জো বাইডেন সরকার সাময়িক বিরতির সমর্থন করেন, যা ২০২৩ সালের নভেম্বরে হয়েছিল।
এপ্রিলের শুরুতে, প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে যে জো জো বাইডেন নেতানিয়াহুকে বলেছেন, ‘মানবিক পরিস্থিতি অগ্রহণযোগ্য’ এবং ‘বেসামরিকদের ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক দুর্ভোগ মোকাবেলা করতে সেইসাথে গাজায় নিয়োজিত দাতব্য কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের গাজা সম্পর্কিত মার্কিন নীতিতে সুনির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং পরিমাপযোগ্য পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে যাচ্ছে।’
তবে একই সময়েও, হোয়াইট হাউস ইসরায়েলে অস্ত্রের চালান বজায় রেখেছে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছে যাতে ইসরায়েলকে তাদের বিরুদ্ধে আসা প্রস্তাবগুলো থেকে রক্ষা করা যায়।
এই পদক্ষেপগুলো ফিলিস্তিনপন্থী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তীব্রে আপত্তির মুখে পড়ে।
জো বাইডেনের গাজা নীতি তার পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করবে এমন আশঙ্কা ওই অঞ্চলে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই রয়েছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে, মিশিগান ডেমোক্রেট কংগ্রেসওম্যান রাশিদা তালাইব এক ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন যাতে তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট, আমেরিকার জনগণ এই বিষয়ে আপনার সাথে নেই। আমরা ২০২৪ সালে সেটা মনে রাখব।’
রাশিদা তালাইবের বার্তার পরে, স্ক্রিনটি কালো হয়ে যায় এবং একটি বার্তা সামনে আসে যাতে বলা হয়: ‘জো বাইডেন ফিলিস্তিনি জনগণের গণহত্যাকে সমর্থন করেছিলেন। আমেরিকার মানুষ ভুলবে না। বাইডেন, এখন একটি যুদ্ধবিরতি সমর্থন করুন। অথবা ২০২৪ সালে আমাদের উপর নির্ভর করবেন না।’
এপ্রিলের মাঝামাঝি ইউএসএ টুডে পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বাইডেনকে সমর্থন করেছিল, যেখানে ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৩৭ শতাংশ।
এসব পরিসংখ্যান তখন বাইডেনের অনুকূলে থাকলেও এখন তার অবস্থান ২০২০ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে নিচে নেমে এসেছে। তখন, এই পর্যায়ে, বাইডেনের পেছনে ৬০ শতাংশ তরুণের সমর্থন ছিল এবং ট্রাম্পের ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ।
জরিপ অনুসারে, ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা কমার পেছনে একটি কারণ হলো গাজার যুদ্ধ।
যেহেতু তরুণদের একটি বড় অংশ মনে করে যে, ইসরায়েলের পদক্ষেপগুলো ন্যায়সঙ্গত নয়।
এপ্রিলের শেষের দিকে সিএনএন এর প্রকাশিত আরেকটি সমীক্ষা থেকে ধারণা করা যায় জো বাইডেন যে ইস্যুতে সবচেয়ে খারাপ রেটিং পেয়েছিলেন তা হলো ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধ পরিচালনায় আমেরিকার ভূমিকা।
মাত্র ২৮ শতাংশ মানুষ এর অনুমোদন দিয়েছিল এবং ৭১ শতাংশ অসম্মতি জানিয়েছিল এবং অসম্মতির পক্ষে তরুণদের অবস্থান অর্থাৎ যাদের বয়স ৩৫ বছরের কম তাদের অবস্থান বাড়তে বাড়তে ৮১ শতাংশে ঠেকেছে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ রবার্ট কোহেন বিবিসিকে বলেছেন, ‘ছাত্র আন্দোলন মূলত ভয় তৈরি করছে যে জো বাইডেন এই যুদ্ধের জন্য তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনি এলাকাগুলো হারাতে বসেছেন- বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের সমর্থন হারাচ্ছেন - যা নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে।’
বিবিসির হিসাব অনুযায়ী, ২ মে পর্যন্ত, গাজার যুদ্ধের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ইতোমধ্যেই ৪৫টি রাজ্যের প্রায় ১৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছে। যাতে গ্রেফতার হয়েছের দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।
এই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বোঝা যায় বিক্ষোভের পরিধি এবং তীব্রতা কতোটা বাড়ছে। যা বাইডেনকে ঘিরে আরও বেশি দ্বিধা তৈরি করছে।
“যুদ্ধের মতোই, ক্যাম্পাসের এই বিক্ষোভগুলো জো বাইডেনকে ক্রমেই চাপের মধ্যে ফেলেছে। বাইডেনের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার প্রচারণায় এই তরুণ ভোটাররা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা কিন্তু তিনি এই তরুণদের খেপিয়ে তুলেছেন। সেইসাথে আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হওয়ায়, বা ইহুদি-বিদ্বেষের অভিযোগের প্রতি অন্ধ অবস্থান নেয়ার কারণেও তাকে বড় ধরনের রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে,” বলেছেন বিবিসির ওয়াশিংটন সংবাদদাতা অ্যান্থনি জার্চার।
এখন থেকে আগস্টের মধ্যে ছাত্র বিক্ষোভ কোনদিকে যাবে তা দেখার বিষয়, তবে গত এপ্রিলে বেশ কয়েকটি ফিলিস্তিনিপন্থী দল ডিএনসি-এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছে।
ইউএস প্যালেস্টাইন কমিউনিটি নেটওয়ার্কের নেতা হাতেম আবুদায়েহ ঘোষণা করেছেন, ‘ডিএনসি বিরোধী মিছিলটি শিকাগোর ইতিহাসে ফিলিস্তিনের জন্য সবচেয়ে বড় সমাবেশ হবে।’
“আগস্ট মাসে, আমরা আশা করি যে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি, আরব, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিন, এশিয়ান এবং অন্যান্য বিক্ষোভকারীরা ‘জেনোসাইড জো’ বাইডেন, খুনি কমালা [ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস]উচ্চস্বরে এবং স্পষ্টভাবে বলবে যেন ইসরায়েলে মার্কিন সাহায্য বন্ধ করা হয়, ইসরায়েলকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করা হয়,” তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সম্প্রচারিত এক ভিডিওতে এ কথা বলেন।
এই ঘোষণাগুলোর মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হচ্ছে যে যুদ্ধের কারণে জো বাইডেনের প্রচারাভিযান কতোটা সংকটের মুখে পড়েছে।
অ্যান্থনি জার্চারের ভাষায়, ‘জো বাইডেনের কূটনৈতিক দল যদি শিগগিরই গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে অগ্রগতি করতে না পারে তাহলে ক্যাম্পাসের অস্থিরতা বাইডেনের জন্য খারাপ দিন বয়ে আনতে যাচ্ছে।’সূত্র: ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা
এনবিএস/ওডে/সি


