কেন বার বার বালুচ জঙ্গিদের টার্গেট চিনারা

‘ফেয়ারওয়েল’! ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানের সময় অনুযায়ী দুপুর ১২ টা বেজে ১০ মিনিটে টুইটারে এই বার্তা টাইপ করেন শারি বালুচ। বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (Baloch China) সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে তিনি ওই বার্তা পাঠান। তাঁর মুখ ঢাকা ছিল বোরখায়। শরীরে জড়ানো ছিল বিস্ফোরক। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন করাচি ইউনিভার্সিটির গেটের বাইরে। দূর থেকে আসছিল একটি ভ্যান। তার ভেতরে ছিলেন তিনজন চিনা লেকচারার। ভ্যানটি কাছে আসতেই শারি বিস্ফোরণ ঘটান। বিকট শব্দ হয়। ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারপাশ। তিন চিনা নাগরিক (Baloch China) ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

শারি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। এমএসসি করার পরে এম ফিল-ও করেছেন। তিনি দু’টি সন্তানের জননী। যদিও নিশ্চিত মৃত্যুর আগে সন্তানদের থেকে বিদায় নেননি। শুধু বালুচ জঙ্গিদের (Baloch China) উদ্দেশে বার্তা পাঠিয়েছেন, ‘অলবিদা’।
 
চিনাদের ওপরে বালুচ জঙ্গিদের (Baloch China) আক্রমণ এই প্রথম নয়। গত বছর তারা পাকিস্তানের উত্তরে একটি বাস উড়িয়ে দেয়। বাসে চিনা নাগরিকরা ছিলেন। ২০১৮ সালে করাচির চিনা কনস্যুলেটে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটাতে চেষ্টা করে বালুচ লিবারেশন আর্মি। পুলিশের তৎপরতায় সেবার কনস্যুলেট রক্ষা পায়। ২০২০ সালে বালুচ জঙ্গিরা পাকিস্তানের শেয়ার বাজারে হামলা চালায়। সেখানে চিনারা বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করা আছে। চিনা কোম্পানিগুলিকে ধাক্কা দেওয়াই জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল।

বালুচ জনজাতির সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সম্পর্ক কখনই ভাল ছিল না। চিন হল পাকিস্তান সরকারের বন্ধু। শত্রুর বন্ধু আমার শত্রু। এই নীতিতে বিশ্বাসী বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি। সুতরাং চিনকে তারা শত্রু বলেই মনে করে। সম্প্রতি বালুচিস্তানের ওপর দিয়ে তৈরি হচ্ছে চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর। বালুচদের এক বড় অংশের ধারণা, এর ফলে তাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করতে চিনের সুবিধা হবে। এই ধারণা থেকে বেড়েছে তিক্ততা।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বালুচিস্তান স্থির করে, তারা পাকিস্তানে যোগ দেবে। কিন্তু বালুচদের এক বড় অংশ ছিলেন ওই সিদ্ধান্তের বিরোধী। স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শুরু হয় বালুচদের মিছিল-মিটিং। সেই সঙ্গে চলতে থাকে জঙ্গি কার্যকলাপ। পাকিস্তানের শাসকরা সেনা পাঠিয়ে জঙ্গিদের মোকাবিলা করে। কড়া হাতে সন্ত্রাসবাদ দমন করা হয়। তা সত্ত্বেও বালুচিস্তানে মোট পাঁচবার অভ্যুত্থান ঘটে।
২০১৩ সালে চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর তৈরি শুরু হয়। চিনের শিনজিয়াং প্রদেশ থেকে ওই পথ যাবে পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়া, গিলগিট-বালটিস্তান, পাঞ্জাব, বালুচিস্তান, সিন্ধু ও অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে। ওই পথ দিয়ে চিনের পণ্য খুব দ্রুত পৌঁছে যাবে পাকিস্তানে গাওয়াদার বন্দরে। সেই পণ্য নিয়ে বড় বড় জাহাজ পাড়ি দেবে আফ্রিকা আর পশ্চিম এশিয়ার উদ্দেশে।

এই প্রকল্প একেবারেই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে ওই রাস্তা নির্মিত হবে, সেখানকার লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। ওই প্রকল্পে স্থানীয় বালুচরা কাজও পাননি। রাস্তা নির্মাণ শুরুর আগে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বালুচিস্তানে হাসপাতাল তৈরি হবে, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হবে। এখনও কোনও প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করা হয়নি।

বালুচরা মনে করে, ওই প্রকল্পে মূলত পাঞ্জাব লাভবান হবে। বালুচিস্তান বরাবরের মতোই বঞ্চিত হবে। বিভিন্ন বালুচ জনজাতির কর্তারা জোর গলায় ওই প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। বালুচ জঙ্গিরা চিনাদের হত্যা করে বেজিং-কে বার্তা পাঠাতে চাইছে, ওই করিডোর বানানোর পরিকল্পনা ত্যাগ কর। না হলে তোমাদের দেশের লোক বিপদে পড়বে।
সম্প্রতি মাছ ধরা নিয়ে বালুচদের সঙ্গে চিনাদের শুরু হয়েছে আরও একদফা বিরোধ। আগে গাওয়াদার বন্দরের আশপাশে আরব সাগরে মাছ ধরতেন বালুচ মৎস্যজীবীরা। তাঁরা গরিব মানুষ। নৌকা চড়ে, অনেক ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এখন চিনা ট্রলারগুলোকে গাওয়াদার বন্দরের আশপাশে মাছ ধরার অনুমতি দিয়েছে। ট্রলার খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ মাছ ধরতে পারে। তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে বালুচদের জেলে নৌকা।
চিনা ট্রলারগুলিকে মাছ ধরার অধিকার বাতিলের দাবিতে ধরনায় বসেছিলেন বালুচ মৎস্যজীবীরা। ২০২১ সালে ২৮ দিন ধরে চলে তাঁদের আন্দোলন। মৎস্যজীবীদের বধূ ও সন্তানরাও আন্দোলনে শামিল হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার স্বীকার করে, বালুচদের দাবি ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু তাদের একটা দাবিও এখনও মানা হয়নি।

কোনও জনগোষ্ঠীর ব্যাপক মানুষের মধ্যে যখন হতাশা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, তখন সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। বালুচদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, আগামী দিনেও চিনাদের ওপরে হামলার চেষ্টা হবে। পাকিস্তান সরকারও যথারীতি সেনাবাহিনী দিয়ে বালুচদের মোকাবিলা করবে।
কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, শুধু গায়ের জোরে বিশ্বের কোথাও সন্ত্রাসবাদকে পরাস্ত করা যায়নি।খবর দ্য ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/একে

news