বাংলাদেশের নতুন নেতার কথা স্পষ্ট—এটি তাঁর বিপ্লব ছিল না, এটি তাঁর স্বপ্ন ছিল না।

কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূস গত সপ্তাহে যে মুহূর্তে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা শিক্ষার্থীর কলটা ধরেছিলেন, তখনই তিনি জানতেন, যা কিছু করা দরকার, তা তিনি করবেন।

শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার আকস্মিক পদত্যাগের কারণে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা পূরণ ও নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ৮৪ বছর বয়সী নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁদের প্রয়োজন। আর তিনি তা তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করেন।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূস তাঁর কার্যালয়ে নির্বাচিত সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত ব্রিফিংকালে ব্যাখ্যা করেন, ‘আমি এটা করছি; কারণ, দেশের তরুণেরা এটাই চেয়েছিল এবং আমি তাদের এটি করতে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘এটা আমার স্বপ্ন নয়, এটা তাঁদের স্বপ্ন। আমি আসলে এটাকে সত্য করতে তাঁদের সাহায্য করছি।’

শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলনে সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ইউনূস গত বৃহস্পতিবার শপথ নেন। তিনি এখনো তাঁর সামনে থাকা কাজের মাত্রা বোঝার চেষ্টা করছেন।

ড. ইউনূস বলেন, সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো নিরাপত্তা পরিস্থিতি।

আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। শত শত থানা আগুনে পুড়ে গেছে। সব পুলিশ সদস্য উধাও হয়ে যান। পুলিশ ইউনিয়ন কর্মবিরতি ঘোষণা করে। এ অবস্থায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেন শিক্ষার্থীরা।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আইনশৃঙ্খলা সবার আগে, যাতে মানুষ স্বস্তিতে থাকতে পারে বা কাজ করতে পারে।

পুলিশ সদস্যরা সড়কে ফিরে আসায় পরিস্থিতির অগ্রগতির প্রথম ঝলক দেখা যায় গতকাল সোমবার। এটি একটি প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু নিরাপত্তা একমাত্র সমস্যা—বিষয়টি মোটেও এমন নয়।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সরকার সম্পূর্ণভাবে ‘হাওয়া’ হয়ে যায়।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ১৫ বছরের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর যা বাকি ছিল, তা হলো বিশৃঙ্খলা, পুরোপুরি বিশৃঙ্খলা।

ড. ইউনূস আরও বলেন, এমনকি সরকার যা করেছে, যা কিছুই করেছে, তার কোনো অর্থ হয় না। প্রশাসন কী জিনিস, সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না।

অধ্যাপক ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, বিশৃঙ্খলার মুখেও আসলে অনেক আশা আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এখানে আছি তাঁদের জন্য, দেশের জন্য তরতাজা নতুন মুখ হিসেবে...কারণ অবশেষে, এই মুহূর্তে দানব চলে গেছে। তাই এটি উদ্দীপনার বিষয়।’

অধ্যাপক ইউনূসের মতে, সংস্কারই মুখ্য বিষয়।

সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের সাধারণ দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের। এই দাবি থেকেই প্রথম আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।

কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী নৃশংস ও প্রাণঘাতী দমন অভিযান চালায়, যা পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়।

বাক্‌স্বাধীনতার দিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সংস্কার খুবই প্রয়োজন।

শেখ হাসিনার সরকারের সময় বাক্‌স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সীমিত ছিল। কারাগারগুলো এমন লোকে ভরা, যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলতে চেষ্টা করেছিলেন।

অধ্যাপক ইউনূস নিজেই অভিযোগ করেছেন, তিনি বাক্‌স্বাধীনতা দমনের শিকার হয়েছেন।

শেখ হাসিনার সরকারের একজন স্পষ্টবাদী সমালোচক অধ্যাপক ইউনূস। ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা হিসেবে তিনি প্রশংসিত। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাঁকে জনশত্রু হিসেবে গণ্য করতেন। তাঁকে একটি মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেন অধ্যাপক ইউনূস।

কিন্তু সামনে আরও বৈপ্লবিক ধারণা আসছে।

প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকবেন। সরকার পতনে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁদের এই পদ দেওয়া হচ্ছে।

ইতিমধ্যে নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। তাঁরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এরপর বিচার বিভাগের সংস্কারের বিষয়টি আছে। শিক্ষার্থীদের চাপে ইতিমধ্যে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন।

অধ্যাপক ইউনূস যুক্তি দেন, বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং অভিযোগ আছে, তারা ‘কিছু উচ্চতর কর্তৃপক্ষের’ আদেশে কাজ করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পরিভাষাগত দিক থেকে তিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন একজন জল্লাদ।

অধ্যাপক ইউনূস স্বীকার করেন, এমন সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, যার সঙ্গে সবাই একমত হবে না। তবে তিনি আশা করেন, আগে যে সিদ্ধান্ত এসেছে, তার চেয়ে ভালো হবে।

ড. ইউনূস বলেন, ‘আমার কাজের অভিজ্ঞতা যা-ই হোক না কেন...আমি বলছি না, আমি একটি সরকার চালাতে পারব। আমি বলছি যে আমার কিছু প্রতিষ্ঠান চালানোর অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। আমি সেই অভিজ্ঞতার যতটা পারি কাজে লাগাব। এমন লোক থাকবে, যারা এটি পছন্দ করবে, যারা এটি অপছন্দ করবে। তবে কাজটা আমাদের করে যেতে হবে।’

news