বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন আবারও আগুনের লেলিহান শিখায় কাঁপছে। গত ২২ মার্চ পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর এলাকায় শুরু হওয়া আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল টেপারবিল ও শাপলারবিল তেইশেরছিলায়। প্রায় ৬ একর বনভূমি পুড়ে ছাই হয়েছে—সুন্দরী, গেওয়া, গোলপাতাসহ নানা প্রজাতির গাছ-গুল্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আর এই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগের কর্মীদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। পানির অভাবে ভোলা নদী থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পাইপ টেনে পানি আনতে হয়েছে! শেষ পর্যন্ত ৬ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও, প্রশ্ন থেকেই যায়—এতবার আগুন লাগার কারণ কী?
এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে গঠিত হয়েছিল ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রধান পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা দীপন চন্দ্র দাস জানান, প্রতিবেদনে আগুনের সম্ভাব্য কারণ ও ভবিষ্যতে প্রতিরোধের বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের ধারণা, মৌয়ালী (মধু সংগ্রহকারী) বা জেলেরা বনে অগ্নিসংযোগ করেই থাকতে পারে। হয়তো চুল্লি জ্বালিয়ে রেখে যাওয়া, সিগারেটের টুকরো ফেলা বা ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানো—এসব কারণেই বারবার দাবানলের মতো ঘটনা ঘটছে।
কিন্তু শুধু দোষারোপ করেই কি সমস্যার সমাধান হবে? সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করীমের কথায়, "আগুন প্রতিরোধে ভোলা নদী পুনঃখনন জরুরি। নদী যত সংকুচিত হচ্ছে, আগুন নেভানোর কাজ ততই কঠিন হয়ে পড়ছে।" এছাড়াও বনের বলাকাঠ কাটার জন্য পাশপারমিট দেওয়া, পাহারা বাড়ানো এবং স্থানীয়দের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
কিন্তু এত সুপারিশের পরও কেন বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি? গত ২১ বছরে সুন্দরবনে ২৪ বার আগুন লেগেছে—এই সংখ্যাটাই বলে দেয়, শুধু তদন্ত বা প্রতিবেদন জমা দিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বনের গভীরে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই নিরাপত্তা বা সচেতনতার বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেন না। আবার কিছু ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগের কথাও শোনা যায়—যেমন জমি দখল বা বন উজাড়ের চক্রান্ত।
এবারের আগুনে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা শুধু গাছপালা পোড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পুড়ে মরেছে বন্যপ্রাণী, ধ্বংস হয়েছে বাস্তুতন্ত্র। সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশেরই নয়, গোটা বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই এর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে কাগজে-কলমে সুপারিশের বাইরে গিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে গণসচেতনতা তৈরি, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করা এবং বন আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ—এসবই এখন সময়ের দাবি।
প্রতিবার আগুন লাগার পর আমরা হাহাকার করি, তদন্ত কমিটি গঠন করি, প্রতিবেদন জমা দিই—তারপর সবই যেন ধুলোয় মিশে যায়। এবার কি কিছুটা হলেও বদল আসবে? নাকি আগামী বছর আবারও একই খবর শুনতে হবে আমরা?
#সুন্দরবন_অগ্নিকাণ্ড #বন_সংরক্ষণ #তদন্ত_প্রতিবেদন #পরিবেশ_সুরক্ষা #চাঁদপাই_রেঞ্জ


