বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা এখন আর শুধু দেশীয় আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিশ্বব্যাপী নজর কেড়েছে। বিশেষ করে, দেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্পে বিপ্লব এনে আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের এই ইলেকট্রনিক্স বিপ্লবের অগ্রভাগে রয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন (Walton)। উদ্ভাবন, দ্রুত প্রবৃদ্ধি এবং শিল্পে নেতৃত্বের মাধ্যমে ওয়ালটন শুধু দেশেই নয়, বিশ্ব দরবারেও বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ, ওয়ালটনের পথচলা এবার স্থান করে নিয়েছে ইউএসএ টুডেতে (USA TODAY), যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (USA) শীর্ষ ৫টি সংবাদপত্রের মধ্যে অন্যতম। এই প্রকাশনা ওয়ালটনের উদ্ভাবনী যাত্রা, অভাবনীয় প্রবৃদ্ধি এবং কীভাবে তারা বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তা তুলে ধরেছে।
ওয়ালটন-এর এই অর্জন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক দিকনির্দেশনা ও উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমঞ্চে নিজেদেরকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।
একসময় বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ মানেই ছিল পোশাক শিল্পের দেশ। কিন্তু আজ চিত্রটা বদলে গেছে। এখন বিশ্ব তাকিয়ে আছে এক নতুন শক্তির দিকে—বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স বিপ্লবের দিকে।
ভাবুন তো—একটা দেশীয় কোম্পানি কীভাবে ৫০টিরও বেশি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে? কীভাবে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ৫ ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ডের একটি হতে চায়? আর কীভাবে এই শিল্প বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন বিনিয়োগ যুগে?
এই পরিবর্তনের গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এক নাম—ওয়ালটন (Walton)। এটি কেবল একটি কোম্পানির সাফল্যের গল্প নয়, বরং পুরো জাতির আত্মবিশ্বাস, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। চলুন, জেনে নেওয়া যাক “মেড ইন বাংলাদেশ”-এর এই মহাকাব্যিক যাত্রা।
বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্প মানেই এখন ওয়ালটনের নাম। দেশের সীমানা পেরিয়ে আজ তারা দাঁড়িয়েছে বিশ্ব মঞ্চে, মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ড হিসেবে।
প্রায় ৩০ হাজার কর্মী কাজ করেন এই প্রতিষ্ঠানে, আর প্রায় ৭০০ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে ২২টিরও বেশি উৎপাদন কেন্দ্র। এখানেই তৈরি হয় ফ্রিজ, টিভি, এসি, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে কম্প্রেসার পর্যন্ত—সবই “Made in Bangladesh” লেবেল নিয়ে।
তাদের প্রবৃদ্ধিও অবিশ্বাস্য—গত অর্থবছরে (FY24) ওয়ালটনের মুনাফা বেড়েছে প্রায় ৭৩ শতাংশ! এটি শুধু একটি কর্পোরেট সাফল্য নয়, বরং বাংলাদেশের শিল্প বিপ্লবের প্রতীক।
ওয়ালটনের লক্ষ্য এখন একটাই—২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ৫ ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ডের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া। ইতিমধ্যেই তারা ৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছে, যার মধ্যে আছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকা। এমনকি, দক্ষিণ কোরিয়ায় তারা স্থাপন করেছে একটি গ্লোবাল রিসার্চ ও ইনোভেশন সেন্টার, যাতে উন্নত প্রযুক্তিতে আরও অগ্রগতি আনা যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, ওয়ালটন শুধু উৎপাদন করছে না—তারা করছে পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন। R600a রেফ্রিজারেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে অবদান রাখছে এবং UNDP ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। অর্থাৎ, ওয়ালটন প্রমাণ করেছে—একটি ব্র্যান্ডের সাফল্য কেবল মুনাফায় নয়, টেকসই উদ্ভাবনেও মাপা হয়।
ওয়ালটনের সাফল্যের পেছনে শুধু একটি কোম্পানির পরিশ্রম নেই—আছে বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক দিগন্তের সূচনা। আজ বাংলাদেশের প্রায় ৮০% রেফ্রিজারেটর, ৭০-৭৫% এয়ার কন্ডিশনার, এবং ৯০% টেলিভিশন তৈরি হচ্ছে দেশীয় কারখানায়। দেশের ইলেকট্রনিক্স বাজারের মূল্য এখন ৫.২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১০-১২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই দ্রুত প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চারটি বড় কারণ—
১️. অভ্যন্তরীণ বাজারের শক্তি: ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের দেশে দ্রুত বাড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও ক্রয়ক্ষমতা। বিদ্যুতায়ন ও সাশ্রয়ী দামের কারণে গ্রামের ঘরেও এখন জায়গা পাচ্ছে ফ্রিজ ও টিভি।
২️. সরকারি নীতি সহায়তা: দেশীয় উৎপাদকদের কর ছাড়, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস, এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) গড়ে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছে সরকার।
৩️. দক্ষ জনশক্তি: পোশাক শিল্পে তৈরি হওয়া কারিগরি দক্ষতা এখন ইলেকট্রনিক্স খাতে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন শুধু “সস্তা শ্রমের দেশ” নয়, বরং উচ্চ-মূল্য সংযোজনকারী শিল্পের কেন্দ্র।
৪️. ভূরাজনৈতিক সুযোগ: চীননির্ভরতা কমাতে বিশ্ব এখন বিকল্প খুঁজছে। আর বাংলাদেশ তার অবস্থান, দক্ষতা ও গুণমানে হয়ে উঠছে এক নতুন “সাপ্লাই চেইন পাওয়ারহাউস”।
এই সবকিছুর মিলেই বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে এক অর্থনৈতিক ক্রসরোডে—যেখান থেকে শুরু হচ্ছে নতুন যুগের ইলেকট্রনিক্স বিপ্লব।
বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স বিপ্লবের গল্প কেবল অর্থনীতির নয়—এটি ভূরাজনীতিরও। যদি ওয়ালটন ২০৩০ সালের মধ্যে সত্যিই বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ব্র্যান্ডের একটি হতে পারে, তবে এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক বিরল অর্জন। এটি প্রমাণ করবে—বাংলাদেশ আর শুধু ক্রেতা নয়, বরং উদ্ভাবনের দেশ।
ওয়ালটনের নতুন প্রজন্মের স্মার্ট রেফ্রিজারেটরগুলো এখন IoT প্রযুক্তিতে যুক্ত, যা সার্ভিস সেন্টারে সরাসরি ডায়াগনস্টিক পাঠাতে পারে। এই স্মার্ট সিস্টেম কেবল গ্রাহকের সুবিধা নয়, বরং বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতীক।
ভিশন ২০৪১-এর লক্ষ্য—বাংলাদেশকে উন্নত ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা। ইলেকট্রনিক্স খাত সেই স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। এটি রপ্তানি বহুমুখীকরণে সাহায্য করবে, পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরতা কমাবে, এবং বিদেশি বিনিয়োগে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে।
বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা আজ বাংলাদেশকে দেখছে এক উদীয়মান শক্তি হিসেবে—যেখানে রয়েছে বাড়তে থাকা বাজার, শক্তিশালী উৎপাদন কাঠামো, ও এক দৃঢ় জাতীয় স্বপ্ন।
ওয়ালটনের এই সাফল্য কেবল একটি কোম্পানির অর্জন নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রতীক। তারা প্রমাণ করেছে—বাংলাদেশ পারে, যদি চায়!
আজ “মেড ইন বাংলাদেশ” মানে শুধু একটি লেবেল নয়, বরং গুণমান, উদ্ভাবন ও বিশ্বাসের প্রতীক। ওয়ালটনের হাত ধরে বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক মঞ্চে নিজের জায়গা দখল করছে।
