দেশের ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন–মার্সেলের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেটে যেই মানববন্ধনের ছবি ভাইরাল হয়েছে—তার পেছনে লুকিয়ে আছে প্রতারণা, ভুয়া পরিচয়, অজ্ঞ অংশগ্রহণকারী আর আত্মসাৎকারীদের এক চক্র। এই প্রতিবেদন শুধু প্রশ্নই তোলে না—বরং দেখিয়ে দেয়, দেশীয় শিল্পকে আঘাত করতে কেমন পরিকল্পিত অপচেষ্টা চলছে।

জাতীয় শহীদ মিনার এলাকায় অনুষ্ঠিত একটি তথাকথিত মানববন্ধন ঘিরে দেখা দেয় তীব্র বিতর্ক। “ক্ষতিগ্রস্ত ডিলার ঐক্য পরিষদ” নামে একটি অপ্রমাণিত ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানো এই ভিড়ে ছিল না কোনো স্বচ্ছ পরিচয়, না কোনো নথিপত্র। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয়—অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই জানতেন না কেন তারা সেখানে, বা কোন অভিযোগ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

প্রতিবেদক যখন অংশগ্রহণকারীদের ডিলার কোড, শোরুম বিবরণ বা অভিযোগের ভিত্তি জানতে চান—অধিকাংশই কোনো উত্তর দিতে ব্যর্থ হন। কেউ এক মুহূর্তে নিজেকে ডিলার, পরের মুহূর্তে কর্মচারী বলে দাবি করেন। আরেকজন বলেন তিনি মিনিস্টার কোম্পানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু ওয়ালটন-মার্সেলের ব্যানারের সামনে দাঁড়ানোর যৌক্তিকতা বোঝাতে পারেননি।

একজন অংশগ্রহণকারী নিজেকে নারায়ণগঞ্জের ডিলার পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও কোনো মামলার নথি দেখাতে পারেননি। বরং প্রশ্ন করা হলে সাংবাদিকের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাছাড়া তিনজন অংশগ্রহণকারী নিজেদের ডিলার দাবি করলেও কেউই ডিলার কোড বলতে পারেননি। এইসব ঘটনাই স্পষ্ট করে—মানববন্ধনটি আসলে ছিল ভাড়াটে লোক দিয়ে সাজানো একটি পরিকল্পিত, বিভ্রান্তিমূলক আয়োজন।

অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে—গাজীপুরের একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানির কাছ থেকে বাকিতে পণ্য নিয়ে সেই অর্থ পরিশোধ না করেই বারবার নতুন পণ্য দাবি করছিল। মানবিক দিক বিবেচনায় কোম্পানি পণ্য দিলেও, তারা দ্বিতীয় দফার পাওনাও ফেরত দেয়নি। বরং যখন কোম্পানি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করে, তখনই তারা ভাড়াটে লোক জড়ো করে ভুয়া মানববন্ধনের পথ বেছে নেয়।

এই চক্রের উদ্দেশ্য শুধু তাদের আত্মসাৎ করা টাকা ঢেকে রাখা নয়—বরং দেশের একটি বৃহৎ স্থানীয় শিল্পকে বেকায়দায় ফেলে দেওয়া। ওয়ালটন–মার্সেলের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, লাখো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার ছড়িয়ে বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের সুবিধা করে দেওয়াই ছিল এই চক্রের মূল উদ্দেশ্য।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ডিলার কোড ছাড়া কোনো দাবি করা আইনের চোখে প্রতারণা। তাই এই মানববন্ধন বৈধ নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত অপতৎপরতা। ভুয়া ব্যানার, অজ্ঞ অংশগ্রহণকারী, মিথ্যা অভিযোগ—এসবই একটি অপরাধী চক্রের সক্রিয়তার প্রমাণ। তারা দেশীয় ব্র্যান্ডের সুনাম ক্ষুণ্ন করে জাতীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।

দেশীয় ইলেকট্রনিক্স খাতে ওয়ালটন–মার্সেলের ভূমিকা বিশাল। কোম্পানিটি প্রায় ৩০-৪০ হাজার মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। পরোক্ষভাবে লাখো মানুষ এর সাথে যুক্ত। রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে ভুয়া অভিযোগ তুললে তা শুধু প্রতিষ্ঠান নয়—দেশের অর্থনীতির ওপর সরাসরি আঘাত আনে।

জনমতের প্রতিক্রিয়াও ছিল তীব্র। মানুষ বলছে, যখন দেশে প্রতিদিন চাকরির সুযোগ কমছে, তখন এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা জাতীয় দায়িত্ব। একটি শিল্পকে ধ্বংস করলে শুধু মালিক নয়—হাজারো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বিক্ষুব্ধ জনতা দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি তুলেছে।

আইনজ্ঞরা বলেন—যদি ওয়ালটন–মার্সেলের মতো স্থানীয় শিল্পকে লক্ষ্য করে পরিকল্পিত বিভ্রান্তিকর চক্রের শাস্তি নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দেশীয় উৎপাদন খাত আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়বে। কারণ, এই ধরনের চক্র বড় কোম্পানিকে টার্গেট করে অনর্থ সৃষ্টি করতে পারে এবং বাজারে বিশৃঙ্খলা ছড়াতে পারে।

২৫ নভেম্বরের মানববন্ধন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—এটি কোনো প্রকৃত ডিলারের অধিকার আদায়ের আন্দোলন নয়। প্রকৃত ডিলাররা কখনো ডিলার কোড ছাড়া অভিযোগ করেন না। বরং এটি ছিল একটি আত্মসাৎকারী চক্রের অপপ্রয়াস, যেখানে ভাড়াটে লোক দিয়ে মিথ্যা প্রচারণা ছড়ানো হয়েছে, যাতে কোম্পানির আইনি প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়।

ব্যানারে ভুল তথ্য, অংশগ্রহণকারীদের অজ্ঞতা, অভিযোগের অসংগতি—সবকিছু মিলিয়ে পুরো আয়োজনটি ছিল দেশের সবচেয়ে সফল ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্র। শুধু অভিযোগই নয়, বরং এর উদ্দেশ্য ছিল সর্বসাধারণকে ভুল পথে পরিচালিত করা এবং কোম্পানির ভাবমূর্তি নষ্ট করা।

এই বিভ্রান্তিকর মানববন্ধন থেকে স্পষ্ট—যারা আত্মসাৎ করে কোম্পানির ক্ষতি করেছে, তারা এখন উল্টো কোম্পানিকেই দোষারোপ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তদন্তে বাস্তবতা প্রকাশ পেতে শুরু করেছে, এবং চক্রের মুখোশ একে একে খুলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মতো দেশীয় শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে ওয়ালটন–মার্সেলের ভূমিকা বাড়ন্ত। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো অপপ্রচার মানে দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা। তাই শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন—স্থানীয় শিল্পকে রক্ষা করা মানে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত রাখা। এই চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

মানববন্ধনের নামে যে নাটক সাজানো হয়, তার সবকিছুই মিথ্যা, ভুয়া এবং পরিকল্পিত অপচেষ্টা। একটি প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট করতে ভাড়াটে লোক দিয়ে সাজানো চক্রকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। দেশীয় শিল্প রক্ষায় জরুরি তদন্ত, কঠোর আইনগত ব্যবস্থা এবং জনসচেতনতা এখন সময়ের দাবি। দেশের স্বার্থে সত্য প্রকাশ করা আমাদের দায়িত্ব।

news