ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৪ হাজার ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। নয়াদিল্লি দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে মানব পাচার, অনুপ্রবেশ এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত প্রায়ই সহিংস বিদ্রোহের জন্য পরিচিত হওয়ায় সেটি ভারতের জন্য আলাদা চিন্তার বিষয়।
নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাসিনার প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল ছিল ভারত। তার বিদায় এখন নয়াদিল্লির জন্য একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ভারতের আরেকটি উদ্বেগ হচ্ছে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা। বাংলাদেশের মোট ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বসবাস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ভালো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় এবং দেশটিতে হাসিনার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি হোক, সেটা চায় না।
পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়া ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শেখ হাসিনার উপস্থিতি ভারতের জন্য একটি স্পর্শকাতর সমস্যা।’
তিনি বলেন, ‘যদিও ভারত তার বন্ধুদের, এমনকি যারা অভ্যুত্থানের ফলে অপসারিত হয়েছে তাদেরও আতিথেয়তা দিতে চায়, হাসিনা এখন সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। তার ভারতে স্থায়ী অবস্থান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার থেকে মানবিক অপরাধের অভিযোগ এনে হাসিনার প্রত্যর্পণ দাবি করার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।’
বিসারিয়া মনে করেন, হাসিনার উপস্থিতি ভারতের সাথে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক গড়ার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
অজয় বিসারিয়া আরো বলেন, ‘নিজের নিরাপত্তার জন্য এবং অতিথিদের অস্বস্তিতে ফেলতে না চাইলে, শেখ হাসিনা ভারতে সাময়িকভাবে থাকতে চাইবেন। তারপর স্থায়ী আশ্রয় নিতে যুক্তরাজ্য বা অন্য কোনো পশ্চিমা দেশে যাবেন।’
তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারত সরকার ‘নির্বাসনে থাকা সরকারকে’ সমর্থন করবে না কারণ এটি বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে পারে।
নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন বলেছেন, হাসিনার ভারতে অবস্থান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না।
তবে পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন, তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনার চেষ্টা শুরু করা আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ।
চ্যানেল ২৪ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি জানি, তিনি (হাসিনা) পদত্যাগ করেছেন এবং পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় যদি তাকে ফেরত আনার জন্য আমাদের চিঠি লেখার নির্দেশ দেয়, আমি লিখব।’
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সাবেক সদস্য ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জয়দেব রানাদে বলেছেন, হাসিনা ‘একটি এমন দেশে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজবেন যেখানে প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা কম বা নেই।’
তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারত হাসিনাকে সাময়িক আশ্রয় দিয়ে ‘সঠিক কাজ’ করেছে।
তিনি ডয়েচে ভেলেক বলেন, ‘আমাদের হাসিনার ওপর অতিরিক্ত রাগ দেখানো দেখা উচিত নয়। তার এবং আওয়ামী লীগ (পার্টি) সমর্থকদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা রয়েছে।’
ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, যিনি ঘটনাগুলো ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করছেন, তিনি বলেন, হাসিনার ভারতে অবস্থানের সময়সীমা নির্ধারণ করা কঠিন এবং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।
তিনি বলেন, ‘যখন তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিবার অন্যান্য সদস্যদের ১৯৭৫ সালে হত্যা করা হয়েছিল, তখন তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসেছিলেন।’
পিনাক চক্রবর্তী আরো বলেন, ‘চ্যালেঞ্জগুলো ব্যক্তিগত হতে পারে। আমি মনে করি, তিনি একটি অন্য দেশে যেতে চাইবেন। কিন্তু তার দল নির্বাচনের সময় তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।’
বিকল্প খোলা রাখা
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে শক্তিশালী কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
ভারতীয় সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১৫.৯ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল। দুই দেশই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করতে চেয়েছিল।
জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় গবেষণা কেন্দ্রের সঞ্জয় ভারদ্বাজ বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের কোনো সরকারেরই ভারত থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়।
ভারদ্বাজ ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার ভারতে থাকা রাজনৈতিক নয়, বরং এটি একটি কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে বাণিজ্যিক সুবিধা পায়। ভূমি সীমান্ত ও ভালো পরিবহণ ব্যবস্থা পণ্যের চলাচল সহজ করে, যা দূরের দেশ যেমন চীন থেকে আমদানির তুলনায় কম খরচে হয়ে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাক উৎপাদন খাত, যেটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি মূল চালক সেটি ভারত থেকে কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।’
এই মুহূর্তে ভারত তার বিভিন্ন বিকল্প খোলা রেখেছে এবং হাসিনা কতদিন ভারতে থাকবেন তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি।
ভারতের বাহ্যিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের সাবেক প্রধান অমরজিৎ সিং দুলাত ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘তিনি কোথায় যাবেন? আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখার জন্য সময় দিতে হবে, বিশেষ করে যদি ভারত নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।’