ফ্লোরিডায় ফিরেই মামলা সংশ্লিষ্টদের তীব্র সমালোচনা করলেন ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রেপ্তারের পর নিউইয়র্কের আদালতে আত্মসমর্পন করেন গত মঙ্গলবার দুপুরে। আদালতে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের কর ৩৪টি অভিযোগ থেকে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। আদালতে প্রায় দেড় ঘন্টাস্থায়ী শুণানীর পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। আদালত থেকে বেরিয়েই তিনি সন্ধ্যায় ফ্লোরিডা তার বাসভবন মার-এ-লাগোতে ফিরে যান। সেখানে ফিরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন ট্রাম্প। তিনি মামলার বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের তীব্র সমালোচনা করেন।
ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোয় নিজ সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্যে ট্রাম্প কড়া ভাষায় বিচার সংশ্লিষ্ট সবার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, আমার একমাত্র অপরাধ যারা আমাদের দেশকে ধ্বংস করতে চায় আমি নির্ভয়ে তাদের কাছ থেকে দেশকে রক্ষা করেছি। তিনি দাবি করেছেন, একাধিক বিষয়ে তদন্ত করে তাকে আক্রমণ করা হয়েছে।
সাবেক বলেন, শুরু থেকে, ডেমোক্র্যাটসরা (জো বাইডেনের দল) আমার প্রচারণার ওপর নজরদারি চালিয়েছে। তারা আমার ওপর তদন্তের হামলা চালিয়েছে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি করে জো বাইডেন জয় পেয়েছেন বলে আবারও দাবি করেছেন ট্রাম্প।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটন আদালতের জেলা অ্যাটর্নি ব্রাগেরও কড়া সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। ব্রাগই ট্রাম্পকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। অ্যাটর্নি ব্রাগকে উদ্দেশ্য করে ট্রাম্প বলেছেন, আলভিন ব্রাগ একজন ক্রিমিনাল। তার বিচার হওয়া উচিত অথবা তার পদত্যাগ করা উচিত। ট্রাম্প বলেন, জেলা অ্যাটর্নির অফিসের একটি ওয়েবপেইজও ছিল। যারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এসব করেছে সেখানে বৈঠক করত তারা।
এরপর ম্যানহাটন আদালতের বিচারক জুয়ান মার্চেনের সমালোচনা করেন ট্রাম্প। সাবেক প্রেসিডেন্টের দাবি, তার বিরুদ্ধে এমন একজন বিচারক বিচার কাজ পরিচালনা করছেন যার পুরো পরিবার ট্রাম্প বিরোধী। তিনি বলেছেন, আমার একজন ট্রাম্প-ঘৃণাকারী বিচারক আছে, সঙ্গে আছে তার ট্রাম্প-ঘৃণাকারী স্ত্রী ও পরিবার।
ট্রাম্পের দাবি, বিচারক জুয়ান মার্চেনের স্ত্রী তার বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে টুইট করেছিলেন। অপরদিকে তার মেয়ে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের হয়ে কাজ করেছেন।
এরপর বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার প্রশাসনের সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খারাপ। আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাশিয়া চীনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। যদি আমি আপনাদের প্রেসিডেন্ট থাকতাম তাহলে এর কিছুই হতো না।
এছাড়া ট্রাম্প বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের প্রসঙ্গ টানেন। তিনি দাবি করেন হান্টার বাইডেন নিজের ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ ঠিক করাতে দিয়ে সেটি নিতে ভুলে যান। এরপর ওই ল্যাপটপের ভেতর থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যেসব তথ্য থেকে জানা যায়, হান্টার তার পরিবারের পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায় করে নিতে চেয়েছিলেন। হান্টার ও জো বাইডেনসহ সবাইকে ক্রিমিনাল পরিবার হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ ও বিচার এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অবিশ্বাস ও ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন। পর্ণ তারকাকে গোপনে অর্থ দেয়ার এবং তা নিয়ে এমন ঘটনা আমেরিকায় ঘটতে পারে তা তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি।
এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্পের এক থেকে চার বছরের জেল হতে পারে। এটর্নি ব্রাগ ট্রাম্প, তার সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকে কোহেন এবং আমেরিকান মিডিয়া ইনকরপোরেশনের নির্বাহীবৃন্দ ও ন্যাশনাল ইনকয়ারাপ টেবলয়েডএর প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
ট্র্রাম্প কোন অন্যায় করার কথা অস্বীকার করেছেন এবং তার বিশ্বাস ব্রাগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উইচ হান্টিংয়ের শিকার হয়েছেন তিনি। ডেমোক্র্যাপ ব্রাগ তার ২০২৪ সালের প্রেসিডন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার প্রচেষ্টাকে বিঘ্নিত করতে চান।
আদালতে যা ঘটেছিল: সবিবিসির একজন সাংবাদিক আদালত কক্ষে ট্রাম্পের ঠিক ৫ সারি পেছনে বসে তার শুণানী পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে তিনি ও আরো কয়েকজন সাংবাদিক বসেছিলেন। প্রায় এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন সেখানে তাদেরকে ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহারে বাঁধা দেন।
ট্রাম্প মলিন মুখে বিচারকের কক্ষে প্রবেশ করেন। তিনি ধীর পায়ে হেটে সামনের সারিতে তার আসনে যেয়ে বসেন। সেখানে তার আইনজীবীরা অপেক্ষা করছিলেন।
বিচারক জুয়ান মেরচান যখন আসলেন তখন ট্রাম্পসহ সবাই উঠে দাঁড়ান। আদালত কক্ষের বাইরে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক সার্কাস চলা সত্ত্বেও বিচারক মেরচান শান্তভাবে শুণানী গ্রহণ করেন। তিনি কখনো তার স্বর উচ্চ করেননি।
মুলত আইনজীবীদের জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য করাসহ পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে এ শুণানী চলে। কিন্তু কক্ষের সবাই এর গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি গত মঙ্গলবার আদালতে ফৌজদারি অভিযোগের সম্মুখীন হলেন। তবে আদালত কক্ষে তার মুখচ্ছবি ধারণ করা হযনি। কিন্তু নথিবদ্ধ করার জন্য তার আঙ্গুলের ছাপ গ্রহণ করা হয়েছে।
এর আগে তার আইনজীবীরা যুক্তি দেন যে, তাদের মক্কেল একজ বিশ্বের সুপরিচিত মুখ, তাই তার মুখচ্ছবি গ্রহণের কোন দরকার নেই। এতে তার সাদাকালো ভুয়া মুখচ্ছবিসহ ৪৭ ডলার মূল্যের টি শার্টের পুণনির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হবে না। সামাজিক যোগায়োগ মাধ্যমে তার এ মুখচ্ছবি ব্যাপক প্রচারিত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভুয়া বানিজ্য রেকর্ড সম্পর্কিত ৩৪ অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রিপাবলিকান দলের শীর্ষ প্রার্থী হলেন ট্রাম্প। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণাকালে গোপন অর্থ প্রদান করা। ম্যানহাটান জেলা এটর্নি আলভিন ব্রাগের কয়েক বছরব্যাপী তদন্তের পর বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।
ম্যানহাটানের গ্রান্ড জুরি ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার এক সপ্তাহ পরে তিনি আদালতে উপস্থিত হন। ব্রাগ অভিযোগ করেন যে, ২০১৬ সালের নির্বাচনে আগে ও পরে ট্রাম্প বানিজ্যিক রেকর্ডের ভুয়া তথ্য দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি আমেরিকান ভোটারদের কাছে ‘ক্ষতিকর তথ্য ও কর্মকান্ড গোপন করেছেন।’ ব্রাগ বলেন, নির্বাচনকালে ট্রাম্প ও অন্যান্য কর্মচারি একটি ‘সনাক্ত ও দূর করা’ প্রকল্পের আওতায় নেতিবাচক তথ্য কেনাও গোপন করার এবং তার নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা জোরদার করার চেষ্টা করেছেন। এতে বানিজ্য রেকর্ডে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়েছে যাতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইন লংঘিত হয়েছে।
কোহেন ট্রাম্পের পক্ষে ডেনিয়েলসকে অর্থ দিয়েছিলেন। তিনি পরে তার সাবেক বসের বিপক্ষে চলে যান। গোপন অর্থদান, কর ফাঁকি ও অন্যান্য অপরাধে ট্রামের তিন বা চার বছরের জেল হতে পারে।
শেষাবধি কি হতে পারে: শুণানীর সময়ে ট্রাম্পের আইনজীবী টোড ব্লানশ অভিযোগগুলোকে ‘বয়লারপ্লেট’ বলে উল্লেখ করে নাকচ করে দিয়েছেন। বিচারক ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিচারের প্রাথমিক তারিখ ধার্য করেছেন। ট্রাম্পের আইনজীবীরা আগষ্ট মাসের ৮ তারিখের পূর্ব মামলা দায়ের করতে পারবে। ট্রাম্পের আইনজীবীরা মামলার মোশন ফাইল করতে ৮ আগষ্ট পর্যন্ত সময় পাবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঘটনার একটি নজীরও আছে। ২০১২ সালে সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন এডওয়ার্ডসকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বান্ধবীকে দিয়ে প্রচারণার কাজে এক নারীকে গোপনে অর্থ দেয়ার কারণে এ মামলা হয়। এ মামলায় জুরিদের মধ্যে অচলাবস্থা দেখা দেয়ার পর মামলাটি সে সময় খারিজ হয়ে যায়।
এনবিএস/ওডে/সি


