বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের নদী-খালে এখন চলছে বিষের খেলা। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এক শ্রেণির অসাধু জেলে ও বনদস্যুদের হাতে প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে বনের জীববৈচিত্র্য। কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকারের এই নিষ্ঠুর পদ্ধতি শুধু মাছই নয়, হুমকি তৈরি করেছে বনের গোটা ইকোসিস্টেমের জন্য।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিশেষ করে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। স্থানীয় জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা বনরক্ষীদের "মাসোহারা" দিয়ে এই অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "ট্রলার প্রতি ১০ হাজার আর নৌকা প্রতি ৫ হাজার টাকা দিলে বনরক্ষীরা চোখ বুজে থাকেন। মাছ বিক্রি করতে গেলেও পুলিশ-প্রশাসনের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়।"
বিষ প্রয়োগের পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়, জেলেরা মধ্য ভাটার সময় খালের এক পাশে জাল পেতে অন্যপাশে বিষ ছিটায়। রিপকর্ড, ক্যারাটে, হিলডন, ওস্তাদসহ নানা ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। বিষক্রিয়ায় মাছগুলো দুর্বল হয়ে জালে আটকা পড়ে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় শুধু বড় মাছই নয়, মারা পড়ে লক্ষ লক্ষ মাছের পোনা, চিংড়ি ও কাঁকড়া।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মুজাহিদুল ইসলাম সতর্ক করে বলেন, "এই বিষাক্ত মাছ খেলে মানুষের কিডনি, লিভার ও হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।" মৎস্য কর্মকর্তা রণজিৎ কুমার যোগ করেন, "একবার বিষ দেয়া খালে ৩-৫ দিন কোনো মাছ বাঁচে না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় পুরো এলাকায় মাছের প্রজননই বন্ধ হয়ে যাবে।"
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী ব্যাখ্যা করেন, "বিষ শুধু মাছই মারে না, এটি পানিতে মিশে সমগ্র ইকোসিস্টেমকে ধ্বংস করে। এই বিষ ভাটার টানে গভীর সমুদ্রে চলে যায়, সেখানকার প্রাণীদেরও মারে। পাখি ও অন্যান্য প্রাণী যারা মাছ খায়, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।"
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে সুন্দরবনে অবৈধ অনুপ্রবেশের ১১৬টি মামলা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ৮টি ট্রলার, ১৯৩টি নৌকা, ৬৩৯ কেজি চিংড়ি, ১৯০ কেজি কাঁকড়া ও ১৪টি বিষের বোতল। কিন্তু স্থানীয়রা জানান, এগুলো শুধু আইনের খেলাপ মাত্র। আসল অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমান স্বীকার করেন, "আমরা জনবল সংকটে ভুগছি। সুন্দরবনের শত শত খাল পাহারা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কীটনাশক ব্যবসায়ীরা ভেটখালী, হরিণগর, শ্যামনগরসহ বিভিন্ন বাজারে প্রকাশ্যে এসব বিক্রি করছে। ১০০ টাকার বিষ ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।"
জলবায়ু ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়া হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "মানুষ যদি নিজেরাই সচেতন না হয়, তাহলে আমরা কি করব? রাজহাঁস সোনার ডিম পাড়ে, আর তারা সেই রাজহাঁসটাকেই মেরে ফেলতে চায়।" তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও স্থানীয়দের মতে, শুধু আইন দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে নিতে হবে কয়েকটি পদক্ষেপ: ১. স্থানীয় জেলেদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা, ২. কীটনাশক বিক্রিতে কঠোর নজরদারি, ৩. বনরক্ষী-জেলে আঁতাত ভাঙতে স্বচ্ছ তদন্ত, ৪. স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণসচেতনতা তৈরি, ৫. মৎস্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করে সেখানে কঠোর প্রহরা
সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পুরো বিশ্বের সম্পদ। এই বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব শুধু বন বিভাগের নয়, আমাদের সবার। আসুন, আমরা সবাই মিলে সুন্দরবনের এই অমূল্য সম্পদ রক্ষার শপথ নেই।
#সুন্দরবন_রক্ষা #বিষমুক্ত_মাছ #জীববৈচিত্র্য_সংকট #অবৈধ_মাছ_শিকার #সুন্দরবনের_স্টেকহোল্ডার


