গাজায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে হামাসপ্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে খুঁজছিল ইসরায়েল। হামাসের এই শীর্ষ নেতা ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার পরপরই আত্মগোপনে চলে যান। ৬১ বছর বয়সী সিনওয়ার বেশিরভাগ সময় গাজা উপত্যকার নিচে সুড়ঙ্গের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন।
বলা হচ্ছিল, সুড়ঙ্গের মধ্যে তার সুরক্ষার জন্য কয়েকজন দেহরক্ষী ও ইসরায়েল থেকে আটক করা কিছু জিম্মিকে রাখা হয়েছি। জিম্মিদেরকে ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন তিনি দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের একটি টহলদার দলের মুখোমুখি হন, তখন তার সঙ্গে খুবই কম সংখ্যক দেহরক্ষী ছিলেন। তাছাড়া কোনো জিম্মিকেও সেখানে পাওয়া যায়নি।
সিনওয়ার হত্যার বিস্তারিত তথ্য এখনো আসছে। এই ঘটনা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা যা জানা যাচ্ছে, তা তুলে ধরা হলো।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, বুধবার (১৬ অক্টোবর) তাদের ৮২৮তম বিসলামাক ব্রিগেডের একটি ইউনিট রাফা অঞ্চলের তাল আল-সুলতান এলাকায় টহল দিচ্ছিল। সেসময় তারা তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে ও তাদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বন্দুকযুদ্ধে তিন সশস্ত্র ব্যক্তি নিহত হন। তবে সেসময় সংঘর্ষটি বিশেষ কিছু মনে হয়নি ও সৈন্যরা বৃহস্পতিবার সকালের আগ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ফিরেও যায়নি।
তবে বৃহস্পতিবার যখন ওই তিন ব্যক্তির মরদেহ পরীক্ষা করা হচ্ছিল, তখন একজন হামাস নেতার সঙ্গে নিহত একজনের অদ্ভুত ধরনের মিল লক্ষ্য করা যায়। তবে আত্মঘাতী কোনো ফাঁদ থাকার ঝুঁকি বিবেচনায় মরদেহটি সেখানেই রেখে দেওয়া হয়েছিল। তার একটি আঙুলের অংশ কেটে নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য ইসরায়েলে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে মরদেহটিও ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, আমার বাহিনী জানতো না যে ইয়াহিয়া সিনওয়ার সেখানে ছিলেন, কিন্তু আমরা কাজ চালিয়ে গেছি। ইসরায়েলি সেনারা তিন পুরুষকে বাড়ি বাড়ি ছুটতে দেখেছিল ও নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই তাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
যিনি সিনওয়ার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, তিনি একাই একটি ভবনে দৌড়ে গিয়েছিলেন ও তাকে সেখানে ড্রোনের মাধ্যমে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়। সিনওয়ার যেসব জিম্মিদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়, তাদের কেউই সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তার সঙ্গে এত ছোট একটা দলের উপস্থিতি থেকে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি সবার দৃষ্টির অগোচরেই চলাফেরার চেষ্টা করছিলেন। অথবা যারা তার সুরক্ষার জন্য ছিলেন, তাদের বেশিরভাগ মানুষকেই তিনি হারিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিনওয়ার হত্যার শেষ মুহূর্তগুলো ইসরায়েলের প্রকাশ করা ড্রোন ফুটেজে দেখা গেছে। ড্রোনটি একটি বিধ্বস্ত ভবনের দ্বিতীয় তলার খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। ভেতরে কিছুদূর গিয়ে থেমে যায় সেটি। সেখানে মাথা ও মুখমণ্ডল ঢাকা একজন ব্যক্তিকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকা একটি সোফায় বসে থাকতে দেখা যায়। সোফাগুলোও ধুলায় ধূসর হয়ে ছিল। ড্রোনের কারণেও কিছুটা ধুলা উড়ছিল।
মুখমণ্ডল ঢাকা যে ব্যক্তিকে সিনওয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, তাকে দেখে আহত মনে হচ্ছিল। তার হাতে লাঠির মতো একটা কিছু দেখা যায় যেটা তিনি ড্রোনের দিকে ছুড়ে মারেন। এরপর ভিডিওটি শেষ হয়।
ইসরায়েল বৃহস্পতিবার প্রথমে ঘোষণা করে যে সিনাওয়ার স্থানীয় সময় বিকেলে গাজায় নিহত হয়েছেন কি না, সেই সম্ভাবনার তদন্ত চলছে। এই ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ছবিতে একজন পুরুষের মরদেহের ছবি দেখা যায়, যার সঙ্গে হামাসের শীর্ষ নেতার খুব মিল রয়েছে। তার মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল ও ছবিটি এতটাই ভয়াবহ যে, তা প্রকাশের উপযোগী না।
তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা সে সময় সতর্ক করেন যে নিহত তিনজনের মধ্যে কারও পরিচয় পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। রপর খুব বেশি সময় না যেতেই ইসরায়েলি সূত্রগুলো ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানায়, তারা সিনওয়ারকে হত্যা করেছে সে বিষয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। যদিও তারা বলেছিল যে মৃত্যু নিশ্চিত করার আগে সমস্ত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার।
পরীক্ষাগুলো করতে দীর্ঘ সময় লাগেনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইসরায়েল সিনওয়ারকে হত্যা করার তথ্য নিশ্চিত করে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘অশুভ শক্তি’ বড় ধরনের ‘আঘাতের সম্মুখীন’ হয়েছে। তবে গাজা যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি বলে সতর্কও করেন তিনি।
প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু শেষ নয়
সিনওয়ারকে হত্যা করা ইসরায়েলের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল, তবে তার মৃত্যুতে গাজার যুদ্ধ শেষ হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল।
এদিকে, শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য বাসেম নায়েম এক বিবৃতিতে বলেন, মনে হচ্ছে ইসরায়েল বিশ্বাস করে- আমাদের নেতাকে হত্যা করলেই আমাদের আন্দোলন কিংবা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম থেমে যাবে। কিন্তু তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের সংগ্রামকে তারা কোনোভাবেই শেষ করতে পারবে না। সিনওয়ারের নাম উল্লেখ কিংবা তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত না করে নায়েম বলেন, প্রিয়জন হারানোটা খুবই বেদনাদায়ক।
এদিকে, নেতানিয়াহু বলছেন যে তিনি ‘প্রতিশোধ নিয়েছেন’, যদিও তিনি জোর দিয়ে বলছেন যে হামাসের হাতে বন্দি কমপক্ষে ১০১ জিম্মির জীবন রক্ষার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। জিম্মিদের পরিবারের জন্য বলছি, সিনওয়ারকে হত্যা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আমরা আমাদের প্রিয়জনদের বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পূর্ণ শক্তিতে লড়াই চালিয়ে যাবো।