আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দেশ ছেড়ে সপরিবারে বেলজিয়ামে অবস্থান করছেন। তিনি একমাত্র ছেলে আর স্ত্রী নুরান ফাতেমাকে নিয়ে এখন বেলজিয়ামের লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন। সেখান থেকে হাছান মাহমুদ জার্মানি ও ঢাকা-চট্টগ্রামের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথাবার্তাও।
অন্যদিকে এর আগে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও ভারতের কলকাতায় পালিয়েছেন— বিভিন্ন সূত্রে এমন খবর মিলছে।
আটক হওয়ার পরও হাছান মাহমুদ কিভাবে দেশ ছাড়তে সক্ষম হলেন— এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়াও বিপুল টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাছান মাহমুদসহ ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ১৮ মন্ত্রী ও ৯ সংসদ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করে।
হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন, গত ২৪ আগস্ট সন্ধ্যায় (বেলজিয়াম সময়) হাছান মাহমুদ নিরাপদে বেলজিয়ামে পৌঁছেছেন।
ঢাকা থেকে জার্মানি যান ২৫ আগস্ট
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের নিজস্ব অনুসন্ধানেও হাছান মাহমুদের দেশত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। ওইদিন তিনি বেলজিয়ামে পৌঁছান— এমন তথ্য জানিয়ে ওই সূত্র জানিয়েছেন, হাছান মাহমুদ এখন বেলজিয়ামের লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন। সেখানে তিনি তার শুভাকাঙ্খীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে সময় কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশেও বিভিন্ন জনকে ফোন করে বিভিন্ন নির্দেশ-উপদেশ দিচ্ছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট হাছান মাহমুদ বাংলাদেশ ছাড়েন। ২৬ আগস্ট রাতে তিনি জার্মান বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর ডুসেলডর্ফের একটি রেস্টুরেন্টে যান খাবার খেতে। সেখান থেকে বেলজিয়ামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা জার্মানি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া বকুল এ সময় তাকে সঙ্গ দেন।
এদিকে গত শনিবার (৩১ আগস্ট) হাছান মাহমুদ ফোনে কথা বলেছেন অনলাইনভিত্তিক চ্যানেল ‘সি-প্লাসে’র প্রধান সম্পাদক আলমগীর অপুর সঙ্গে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলমগীর অপু বলেন, ‘শনিবার রাত ১০টা ২৭ মিনিটে হাছান মাহমুদ আমাকে ফোন করেন অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি নাম্বার থেকে। এ সময় তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে বিভিন্ন সময়ে আমার সঙ্গে করা আচরণ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি আমাকে বলেন, বিভিন্ন সাংবাদিক নেতা আমার বাসায় এসে তোমার ব্যাপারে ভুল বুঝিয়েছিল। এরপর আমি যা যা করেছি, আমি যা করেছি, তা ঠিক করিনি। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’
এ সময় তিনি চট্টগ্রামভিত্তিক এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, ‘সে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। তুমি পারলে বিষয়টি দেখবে।’
গত বছরের ২৩ আগস্ট হাছান মাহমুদ ও চট্টগ্রামের সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক আবুল বাশার ফখরুজ্জামানের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ‘সি প্লাসে’র অফিস সিলগালা করে দেন।
পুরনো ঢেরা বেলজিয়াম
হাছান মাহমুদ দীর্ঘদিন বেলজিয়ামে বসবাস করেছেন। সেখানে তার ছোট ভাই স্থায়ীভাবেই থাকেন। দুবাই ও যুক্তরাজ্য ছাড়াও বেলজিয়ামে তিনি বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯২ সালের দিকে প্রথম বেলজিয়াম যান হাছান মাহমুদ। সেখানে তিনি বেলজিয়ামের ব্রিজ ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস ও লিম্বুর্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনাও করেছেন। ২০০১ সালে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে তার ভাগ্য খুলে যায়।
পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে।
শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৮ মন্ত্রী ও ৯ সংসদ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাছান মাহমুদসহ ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ১৮ মন্ত্রী ও ৯ সংসদ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগরের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছে, বিগত সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অকল্পনীয় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদক জানতে পেরেছে, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা সাবেক ১৮ মন্ত্রী ও ৯ জন সংসদ সদস্য দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। সাবেক এসব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করে দুদক।
দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া সাবেক মন্ত্রীরা হলেন— সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী এনামুর রহমান এবং প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, সাবেক ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী ফরিদুল হক খান, সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সাবেক ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী ফরিদুল হক খান, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল।
দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া সাবেক মন্ত্রীরা হলেন— সাবেক সংসদ সদস্য মো. এনামুল হক, বেনজির আহমেদ, কাজী নাবিল আহমেদ, শহিদুল ইসলাম বকুল, একেএম সরওয়ার জাহান, শেখ আফিল উদ্দিন, মেহের আফরোজ, আবু সাঈদ আল মাহমুদ ও শেখ হেলাল উদ্দিনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২৯ আগস্ট সাবেক ৯ মন্ত্রী ও ৫ সংসদ সদস্যের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এরা হলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা, সাবেক সংসদ সদস্য সলিম উদ্দিন তালুকদার, মামুনুর রশিদ, কাজিম উদ্দিন, নুরে আলম চৌধুরী ও জিয়াউর রহমান।
তারও আগে গত রোববার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তার স্ত্রী, কন্যা ও ছেলেসহ ১০ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।