১৫টি স্বর্ণসহ ৩৩টি পদক জয়ী তাহেরা একমাস ধরে বিছানায়, খোঁজ নেয়নি কেউ

 উপযুক্ত বয়েসে বাবা-মা, বড় ভাই বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ্যাথলেট হিসেবে একের পর এক আঞ্চলিক, বিভাগীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কারণে বিয়ের বয়স পেরিয়ে যায়। বসা হয়নি আর বিয়ের পিঁড়িতে।

সুইমিংয়ে ১৫ স্বর্ণপদক জয়ী জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের একমাত্র সাঁতারু মধ্যবয়সী তাহেরা পারভীনের স্বামী, সংসার, অর্থ, সম্পদ, সঞ্চয়, নিজস্ব আশ্রয় কিছুই নেই। আছে শুধু ৩৩টি পদক। এরমধ্যে সাঁতারে ১৫টি স্বর্ণ, হার্ডেলে ৯টি রৌপ্য ও ৯টি ব্রোঞ্জ পদক।

একজন জাতীয় পর্যায়ের সাঁতারু হিসেবে বাংলাদেশের গৌরব তাহেরা পারভিনের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের জন্য অর্জন করেছেন অর্ধশত সনদপত্র, বঙ্গভবনের সংবর্ধনা আর রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদক গ্রহণ। অথচ জীবনের এ কঠিন দুর্যোগের সময়ে এসবের কোন কিছুই তার কাজে আসছে না। জীবন সংগ্রামের মাঝপথে এসে তাকে কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়তে হয়েছে। দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গে গত এক মাস যাবৎ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পিতা-মাতা কেউ জীবিত নেই। বড় ভাই মোল্লা জাহাঙ্গীর কবির বাবুলের করুণায় কোনরকম বেঁচে আছেন।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা সদর হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে এক আত্মীয়ের সহযোগীতায় তিন দিন আগে ভর্তি হন নগরীর শের-ই বাংলা রোডে অবস্থিত খুলনা সেন্ট্রাল হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের চিকিৎসক গৌতম মুখার্জির তত্ত্বাবধানে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

শনিবার (২২ জুন) দুপুরে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ৪০৩ নং কেবিনে তিনি তার দুর্বিষহ জীবনের বর্ণনা দেন। 

তাহেরা পারভীন বলেন, এ্যাথলেট হিসেবে সুইমিং আর হার্ডেল ছিলো আমার ইভেন্ট। এই দুই ইভেন্ট আমাকে ১৫টি স্বর্ণসহ ৩৩টি পদক দিয়েছে। আজ আমার করুন পরিণতির জন্য দায়ী এই দুই ইভেন্ট। সুইমিংয়ে একের পর এক ইভেন্টের কারণে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে, বিয়ে করতে পারিনি। বাবা মা বিয়ে দিতে চেয়েছেন, আমি তাদের বলেছি সামনে ইভেন্ট রয়েছে। একের পর এক ইভেন্টের জন্য আমি বিয়ে করতে পারিনি।

কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমাকে দেখার কেউ নেই। বড় ভাইয়ের সহযোগীতায় বেঁচে আছি। তারও বউ ছেলেমেয়ে সংসার আছে। সে আমাকে আর কত দেখবে? এ পর্যন্ত আমি কোন সাহায্য পাইনি। বিজেএসমিসহ যাদের হয়ে খেলেছি তারা কোন সাপোর্ট দেয়নি। আমি শুধু খেলেই গেছি।

বিজেএমসি ‘র এ্যাথলেট হিসেবে আঞ্চলিক বিভাগীয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুইমিংয়ে অংশ নিয়েছি। গোল্ড মেডেল পেয়েছি। সুনাম হয়েছে তাদের। খেলা শেষে আমাকে শুধু ৫/৬শ’ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। তারা কোন চাকরির ব্যবস্থা কিংবা আর্থিক সহায়তা করে নাই।

তাহেরা পারভিন বলেন, রূপসা উপজেলার দুর্জনীমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা করাকালীন সময়ে ফুফাতো ভাই ফুটবলার শওকতের সাথে বিজেএমসি’র প্লেয়ার হিসেবে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক জয়ী হই। এটাই ছিল জীবনের প্রথম স্বর্ণ পদক জয়ী। সাহস, মনোবল উৎসাহ সবই বেড়ে যায়। এরপর থেকে বিজেএমসি’র নিয়মিত খেলোয়ার হয়ে গেলাম। খালিশপুর ক্রিসেন্ট জুট মিলের মাঠে নিয়মিত প্র্যাকটিস করতাম। 

আমার সুইমিংয়ের কোচ ছিলেন নিমাই দা আর এ্যাথলেটের কোচ ছিলেন বিজেএমসি’র মোস্তাফিজুর রহমান। সুইমিংয়ের কোচ প্রতিদিন ৪/৫ ঘন্টা পিটিআই’র পুকুর, সুইমিং পুলসহ বিভিন্ন পুকুরে সুইমিংয়ের প্র্যাকটিস করাতেন। এমনকি শীতকালেও আমাকে নিয়মিত পুকুরের ঠান্ডা পানিতে প্র্যাকটিস করতে হতো।

এরপর ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ে সাঁতার প্রতিযোগীতায় গোল্ড মেডেল পাই। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বিজেএমসি’র সাঁতার প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল এবং হার্ডেলে ব্রোঞ্জ পদক পাই। ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলাদেশ অলিম্পিক গেমসে সাঁতার প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল এবং হার্ডেলে রৌপ্য পদক রৌপ্য পদক পাই। সাঁতারে স্বর্নপদক পাওয়ায় এ সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে আমরা পদক গ্রহণ করি।

ঢাকা পুলিশ লাইনে অনুষ্ঠিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল, বিভাগীয় পর্যায়ে খুলনা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল, খালিশপুর ক্রিসেন্ট জুট মিলে অনুষ্ঠিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল পেয়েছি।

এছাড়া ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় বিজেএমসি’র খেলোয়াড় হিসেবে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি এবং রৌপ্য পদক পাই। একইভাবে নেপালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তৃতীয় স্থান অধিকার করে ব্রোঞ্চ পদক পাই।

২০০১ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর অসহায় হয়ে পড়ি। সেই থেকে বড় ভাই’র করুনায় কোনমতে বেঁচে আছি। মে মাসের ১৭ তারিখে খুলনা থেকে রপসার দুর্জনীমহল বাড়ি যাওয়ার পথে তেরোখাদা সড়কের বছিরের মোড়ে ট্রাকে এক্সিডেন্ট করি। বাম পায়ের তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায়। খুলনা মেডিকেল কলেজ এবং সদর হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে এক আত্মীয়ের করুণায় গত তিনদিন হল খুলনা সেন্ট্রাল হসপিটালে ভর্তি হয়েছি। একপ্রকার পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন তিনি যদি আমাকে একটু সাহায্য সহযোগিতা করতেন।

তাহেরা পারভিনের বড় ভাই মোল্লা জাহাঙ্গীর কবির বাবুল বলেন, আমার ছোট বোন তাহেরা সারা জীবন খেলাধুলা করে কাটাইছে। আমরা চেষ্টা করেও কখনও তাকে বিয়ে-শাদী দিতে পারিনি। বিয়ের কথা বললে সে বলতো এক ইভেন্টের পর আরেক ইভেন্ট, আমি ভারত যাচ্ছি, নেপাল যাচ্ছি, এই সমস্ত করে সে বিয়ে-শাদী করেনি। এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে পড়ে আছে। দেখার কেউ নেই। আমার সামান্য ইনকাম। সংসার আছে, ছেলে-মেয়ে আছে। বোনের চিকিৎসার এত খরচ কোথায় পাবো? তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছি। 

তিনি বলেন, ক্রীড়া জগতে আমার বোনের অনেক অবদান রয়েছে। সে বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন উনি যেন আমার বোনের প্রতি একটু সদয় হন।

জাতীয় পর্যায়ে একমাত্র সাঁতারু তাহেরা পারভীনের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা খুলনার রূপসা উপজেলার আইজগাতী ইউনিয়নের দুর্জনীমহল গ্রামে। পিতার নাম মোল্লা গোলাম রসুল। ২ ভাই ভাই ৪ বোনের মধ্যে তাহেরা পারভীন সবার ছোট। ১৯৮৫ সালে তেরোখাদা গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন। সূত্র: ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা

এনবিএস/ওডে/সি 

news