রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নানা নামে-বেনামে গঠিত সংগঠন ও অধিকার আন্দোলনের নামে চলছে সভা-সেমিনার, মানববন্ধন ও বিভিন্ন কর্মসূচি। এসব কর্মকাণ্ডের পেছনের উদ্দেশ্য খালি চোখে স্পষ্ট না হলেও, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, মূলত ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করেই এসব আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। অধিকার আদায়ের নামে এসব সংগঠন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে। কেউ কেউ এসব সংগঠনের চাপে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, আবার কারও কারও ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে এমন ডজনখানেক ভুঁইফোড় সংগঠনের সন্ধান পেয়েছে, যারা চাঁদাবাজির জন্য অধিকার আন্দোলনের নাম ব্যবহার করছে।
‘ক্ষতিগ্রস্ত ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন এমনই এক ভুঁইফোড় সংগঠন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি এই সংগঠনের ব্যানারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি চিঠি বিলি করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। তবে মজার বিষয় হলো, চিঠির তারিখ উল্লেখ করা হয় ১০ ফেব্রুয়ারি, অথচ গণমাধ্যমে তা পাঠানো হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। চিঠিতে প্রেরকের কোন ঠিকানা উল্লেখ না থাকলেও, বাইপাল আশুলিয়া সাভারের একটি ঠিকানা পাওয়া যায়। এই ঠিকানাটি ওই নামসর্বস্ব সংগঠনের বলে দাবি করা হয়।
পরে এই প্রতিবেদক চিঠি প্রেরক জাহাঙ্গীর আলম রাজীবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রাজীব জানান, তাকে ওপর থেকে যেভাবে বলা হয়েছে, তিনি সেভাবেই চিঠিটি পাঠিয়েছেন। প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমাকে যেভাবে বলা হয়েছে, আমি সেটাই করেছি। চিঠির তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি উল্লেখ করলেও, ৮ ফেব্রুয়ারি তা পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।" তিনি আরও জানান, এই সংগঠনের কোনো নিবন্ধন নেই। ঢাকা থেকে জনৈক এক ব্যক্তির পরামর্শে তিনি চিঠিটি পাঠিয়েছেন।
জাহাঙ্গীর আলম রাজীবের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি গত এক দশক ধরে সাভারের বাইপালে স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি বেক্সিমকো গ্রুপে কাজ করতেন। গত কয়েক মাস ধরে বেক্সিমকো গ্রুপের অর্থায়নে বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, বাইপালের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল চৌধুরীও এখন অধিকার আন্দোলনের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে লোক জড়ো করে চাঁদাবাজি করছেন।
সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, টঙ্গী, শ্রীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক আন্দোলনের নামে শিল্পকারখানায় অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যেও এ ধরনের ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো জড়িত বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এসব সংগঠন শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের নামে কারখানায় অস্থিরতা সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে এসব সংগঠনের তদন্ত শুরু করেছে। তাদের মতে, এসব সংগঠনের বেশিরভাগই নিবন্ধনবিহীন এবং এগুলো মূলত চাঁদাবাজি ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে। গোয়েন্দারা আরও জানান, এসব সংগঠনের নেতারা রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, "আমরা প্রতিনিয়ত এসব সংগঠনের চাপে রয়েছি। অধিকার আদায়ের নামে তারা আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে। কেউ কেউ তাদের চাপে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।"
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ ধরনের সংগঠনগুলোর তদন্ত ও বন্ধ করতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছে তারা।
এদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এসব সংগঠনের তদন্তে নেমেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে কয়েকটি সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে এসব সংগঠনের নেতারা রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে মামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সর্বোপরি, ভুঁইফোড় সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি ও প্রতারণার এই চক্রটি এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ এসব সংগঠনের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপই কেবল এই সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা


