রাশিয়া ও ইরান তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সহযোগিতা চুক্তি চূড়ান্ত করেছে, যা দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও দৃঢ় করেছে। শুক্রবার, মস্কোয় এই ২০ বছরের চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে। এই চুক্তির মাধ্যমে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি এমন একটি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে উভয় দেশ নিশ্চিত করে যে তাদের ভূমি একে অপরের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।

সিরিয়ার সংকট এবং নতুন চুক্তির প্রয়োজনীয়তা

অনেক বছর ধরে এই চুক্তির পরিকল্পনা করা হলেও সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক চাপে এই উদ্যোগ আরও জরুরি হয়ে ওঠে। ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার কূটনৈতিক অবস্থান সংকুচিত হয়েছে। অন্যদিকে, ইরান ইসরায়েলের আক্রমণ এবং সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের প্রভাব মোকাবিলা করছে।

সিরিয়ার ঘটনা বিশেষভাবে রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক দৃঢ় করার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। সিরিয়ার আসাদ সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যে উভয় দেশের শক্তি হ্রাস করেছে। যুদ্ধের সময় ইরান এবং রাশিয়া আসাদের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তবে আসাদের পতনের পর উভয় দেশই তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার দিকে মনোনিবেশ করেছে।

নতুন চুক্তির মূল দিক

এই চুক্তি রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য বিকল্প আর্থিক ব্যবস্থা এবং জ্বালানি চুক্তির উপর গুরুত্বারোপ করে। এছাড়া, নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোরের মাধ্যমে এশিয়া থেকে রাশিয়ায় বাণিজ্য সুবিধার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা ইরান, আজারবাইজান এবং ক্যাস্পিয়ান সাগরের মধ্য দিয়ে যাবে।

সিরিয়া: সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু

২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়া ও ইরানের সিরিয়ার সঙ্গে স্বতন্ত্র কৌশলগত অংশীদারিত্ব ছিল। রাশিয়া ১৯৭১ সালে ত্রতুস নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে এবং ২০১৫ সালে খমেইমিম বিমানঘাঁটি তৈরি করে। এই ঘাঁটিগুলি কেবল সিরিয়ায় নয়, আফ্রিকার সামরিক কার্যক্রমেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অন্যদিকে, ইরান ১৯৮০-এর দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করে। সিরিয়া ইরানের জন্য হিজবুল্লাহর মতো শিয়া গোষ্ঠীগুলির সাথে সংযোগ স্থাপনের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল।

২০১৫ সালে রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ার যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং আসাদের পক্ষে বিজয়ের পথ সুগম করে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সিরিয়ার পরিস্থিতি উভয় দেশের সম্পর্কের উপর তুলনামূলক কম প্রভাব ফেলেছে।

রিয়ার বাইরে সহযোগিতার প্রসার

রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা সিরিয়ার বাইরেও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া ইরানের ড্রোন ব্যবহার করছে। উভয় দেশই মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক ব্যবস্থার বিকল্প খুঁজছে। ২০২৩ সালে ইরান ব্রিকস গ্রুপে যোগ দেয়, যা রাশিয়ার সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা

যদিও এই চুক্তি রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে, তবুও এতে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ধারা অন্তর্ভুক্ত নয়। এই সীমাবদ্ধতা সিরিয়ায় তাদের সম্পর্কের চ্যালেঞ্জকেও প্রতিফলিত করে। সিরিয়ার পুনর্গঠন এবং নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে মতবিরোধ দেখা গেছে।

পরমাণু অস্ত্র এবং রাশিয়ার ভূমিকা

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে রাশিয়ার অবস্থানও এই সম্পর্কের আরেকটি সীমাবদ্ধ দিক। রাশিয়া ইরানের পরমাণু অস্ত্র অর্জনকে বিরোধিতা করে, কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাশিয়ার বিপক্ষে নিয়ে যেতে পারে। ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলিতে রাশিয়ার সহযোগিতা থাকলেও, তা প্রায়ই বিলম্বিত হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা

সিরিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতি রাশিয়া ও ইরানের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তুরস্ক, ইরান এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তনও এই চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করেছে। তুরস্ক সিরিয়ার নতুন প্রশাসনের উপর প্রভাব বিস্তার করার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

ইরান এখন ইরাকে তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ইরাক এখন ইরানের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তার উৎস এবং প্রতিরক্ষা বাফার হিসেবে কাজ করছে।

রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও অক্ষুণ্ন রয়েছে। যদিও এই সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, তবুও উভয় দেশই তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে ঐক্যবদ্ধ। ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিস্থিতি এই সম্পর্কের প্রকৃতি কিভাবে প্রভাবিত করবে, তা সময়ই বলে দেবে।

news